Thursday, September 5, 2013

চিহ্ন-২৫, আমার রবীন্দ্রনাথ সংখ্যায় রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে উন্মুক্ত গদ্য লিখেছেন হাসান আজিজুল হক, আনিসুজ্জামান, আব্দুল্লাহ আল মামুন, মাসঊদ আখতার, মামুন মুস্তাফা, তারেক রেজা, অনুপম মুখোপাধ্যায়, আবদুল হালিম প্রামানিক, সুপ্রিয়া রাণী দাস ও স্মৃতি রুমানা






















  • রবীন্দ্রনাথ নিয়ে বাঙালির বলার শেষ কোথায়! তাছাড়া বিচিত্র-উপায়ে বা ভাবনায় রবীন্দ্রনাথকে বলা বা উপভোগও করা যায়। সববয়সী সকলেই তা করতেও পারে। কিন্তু সবকিছুর মাঝে আমাদের বাঁচবার অভিজ্ঞানে রবীন্দ্রনাথ কেমন, উত্তর-প্রজন্মই বা তাঁকে কীভাবে নেবে-নিয়ে চলছে, এই অন্যতর মানুষটিকে! এসব প্রশ্ন তো আছে। তাছাড়া বর্তমানের কালযাত্রায় আমরা নানান রঙের যে ভেলা ভাসিয়ে চলছি- সেখানে রবীন্দ্রনাথ কেমন? তিনি কি ফুরিয়ে যান, ফুরান না-কি অগ্রহণীয়তার ডোজে চুরচুর করে ধ্বসে পড়েন! কিংবা আজকাল বাণিজ্যও তো তাঁকে নিয়ে কম হয় না। একাল পেরিয়ে তা কি আরও বাড়বে! এমন নানা ভয়ভীতি আশঙ্কা আতঙ্ক ছাড়িয়ে রবীন্দ্রনাথ চিরঅশেষ- তাতে এতোটুকু দ্বিধা আছে কী! আমার রবীন্দ্রনাথ আয়োজনে মনস্বী দৃষ্টিকোণে রবীন্দ্রনাথকে জানার চেনার বোঝার প্রয়াস। এখানে আমার রবীন্দ্রনাথ শিরোনামে মনস্বী ক’জনার লেখা পত্রস্থ হলো। (স.)
________________________________________________________________




হাসান আজিজুল হক
আমার রবীন্দ্রনাথ

রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে কথা বলতে গেলে আমার সবসময়ই বিপদ ঘটে। আমাকে সমুদ্রে ছেড়ে দিয়ে কেউ যদি বলে নর্থ সি-তে একটিমাত্র  নীল তিমি আছে। আপনি খুঁজে বার করে নিয়ে আসুন কিংবা আকাশে অনন্ত নক্ষত্রবীথির মধ্যে যে বিশেষ একটি নক্ষত্র আমাকে দেখিয়ে দিন। এজন্য রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে কথা শুরু করতে গেলেই আকাশ-পাতালে হারায় কথা, আসলে বুঝতে পারি না, রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে কোথায় শুরু করা যেতে পারে, কিংবা কোন্ জায়গাতে শেষ করা যেতে পারে আর শেষ করে ভাবা যেতে পারে যে যা বলা হয়েছে, তা যথেষ্ট, আর বলার কিছু নেই। রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে আমার সাধারণ একটা জবাব হচ্ছে পৃথিবীতে এইরকম একটি মানুষ জন্মেছিল কেন আর কি জন্য? এদিকে চিন্তা-ভাবনায় আমি রবীন্দ্রানুসারী নই। তাঁর মতন ইতিবাচকভাবে প্রকৃতিকে দেখা, মানুষকে দেখা, সভ্যতাকে দেখা, মানবতাকে অনুধাবন করা এ-সব জায়গাতেই আমার অনেক কথা আছে, সমালোচনা আছে। তারপরও বলছি তাঁর মত মানুষ আমি গোটা পৃথিবীতে খুঁজে পাই না। চিরস্মরণীয় একজন মহাকবি হোমারের কথা বলতে পারি, কিন্তু ঐ মহাকবিই- তারপরে তাঁর সম্পর্কে কিছু জানাও যায় না, বলাও যায় না। আমরা ভার্জিল, দান্তে কিংবা গয়টে বা গ্যেটের কথা তুলতে পারি। এঁরা সব উত্তুঙ্গ ব্যক্তিত্ব, বিশেষ কোনও বিবেচনায় হয়তো রবীন্দ্রনাথের চেয়েও বড় কিংবা বড় বা ছোটোর এই প্রশ্ন অবান্তর। রবীন্দ্রনাথ অন্যরকম। ইউরোপ থেকে এই দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার পার্থক্যটা অন্যরকম তো বটেই, এ-পার্থক্য মুখের কথার পার্থক্য নয়; ইতিহাসেও পার্থক্য। পার্থক্য চেতনায় যেমন তেমনই রয়েছে ধ্যান-ধারণায়। সেক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠত্বের প্রসঙ্গ আসতে পারে না, নিয়ে আসাটাও ঠিক নয়। ইউরোপের প্রেক্ষাপটে বলা যেতে পাওে গ্যেটে অতুলনীয়, কিংবা শেক্সপীয়রের মতন নাট্যকার আর হয়তো জন্মাবে না। কিংবা কেউ বলতে পারে তলস্তোয়ের মতন এমন ঔপন্যাসিক আর কোথায়! দস্তয়েভস্কির মতন লেখক চেখভের মতন গল্পকার! এই সৃজনশীল মানুষদের এককভাবে ধরতে গেলেই এঁরা অতুলনীয়।

কিন্তু রবীন্দ্রনাথকে যখন ভাবতে যাই, তখন বিশেষ কোনো জায়গায় তাঁকে বাঁধতে পারি না। তিনি নিজের সম্পর্কে যাই বলুন না কেন; আমি বলতে পারি না, এটাই রবীন্দ্রনাথের একমাত্র পরিচয়। তিনি যখন বলেছেন আমি জন্ম-রোমান্টিক, সে কথা সত্য হতেই পারে। আবার যখন বলেন, না আমি রোমান্টিক নই, প্রায় সংশয়বাদী, আমি শেষ প্রশ্নের জবাব খুঁজে পাই নি। তখন মনে হয় তাঁকে কী ইউরোপিয়ান চেতনায় এগনস্টিক বলা যাবে, না এ তাঁর দুর্জ্ঞেয় ভারতীয় আধ্যাত্মিকতা? এগনস্টিক হলেন এমনসব মানুষ যারা আস্তিকও নন, আবার নাস্তিকও নন। তাঁকে কি এক্জিস্টেনশিয়ালিস্ট বলা যাবে! জীবনের সংশয় কাটে না; প্রথম দিনের সূর্য সত্তার আবির্ভাবে প্রশ্ন করেছিল, ‘কে তুমি’-মেলে না উত্তর। আবার বহু বছর পেরিয়ে দিবসের শেষে পশ্চিমসাগরতীরে সূর্য শেষ প্রশ্ন উচ্চারিল-‘কে তুমি’ উত্তর মেলে না। মৃত্যুর অল্প কিছু দিন আগে এসব লেখা। সব শেষের কবিতাটিতে দেখি-তিনি লিখেছেন, ‘তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছ আকীর্ণ করি/ বিচিত্র ছলনাজালে হে ছলনাময়ী। মিথ্যা বিশ্বাসের ফাঁদ পেতে সরল জীবনে।’ এই কবিতাটি আমরা পড়েছিলাম ষষ্ঠ শ্রেণীতে । তার নিচে লেখা ছিল, ছাত্রদের এই কবিতার অর্থ জানিবার প্রয়োজন নাই। আমি এখনও অর্থ খুঁজে পাই নি। ‘সত্য যে কঠিন, কঠিনেরে ভালবাসিলাম।’ আমি তাঁর সৃষ্টিতে জীবনের বিচিত্র জাল খুঁজে দেখেছি, আমৃত্যু যে পরম শান্তি কামনা করেছিলেন তা অনুধাবনে সচেষ্ট হয়েছি। জীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতার ক্লান্তি-ক্লেদে স্নান করে, তিনি বলছেন; ‘সমুখে শান্তি পারাবার’-‘দিনান্তবেলায় শেষের ফসল নিলেম তরী ’পরে’ তারপরে ‘যা কিছু নিয়ে চলি শেষ সঞ্চয়/ সুখ নয় সে, দুঃখ সে নয়, নয় সেতো কামনা/ শুনি শুধু মাঝির গান আর দাঁড়ের ধ্বনি তাহার স্বরে।’ কীভাবে যে ব্যাখ্যা করব খুঁজে পাই না। এ-কী শক্তি দেয়? এ-কী শান্তি দেয়? এ কী দর্শন দেয়? কী দেয়? এখনো পৃথিবীর কোনো কবিকে আমি জীবনে সর্বত্র প্রাসঙ্গিক এরকম কাউকে ভাবতে পারি না। সারাবিশ্ব ভরে তাঁর কবিতা কিংবা গান জীবনের যে-কোনও ক্ষেত্রে ব্যবহার করা যায়। খুঁজলেই পেয়ে যাবো ‘লিখন তোমার ধূলায় হয়েছে ধূলি।’ তারপর এক-পর্যায়ে ব্যবহার করছেন ‘আঁখরগুলি’। স্মৃতিকথার নাম দিতে যাই যদি, হারিয়ে যাওয়া আঁখরগুলি-তবে কি চলবে না?

কিন্তু রবীন্দ্রনাথ কোথায় তাঁর কাজের ক্ষেত্র তা কিন্তু বিশেষ করে বলেন নি। আমি এখন ভাবি আচ্ছা রবীন্দ্রনাথ ভাবেন নি কী? তাঁর সমাজ-সাহিত্য-সংস্কৃতি-শিক্ষাকেন্দ্রিক চিন্তাসমূহ যদি বিবেচনায় আনি তবে তা হয়ে যায় এক কথায় অনন্য, ছাড়িয়ে যাওয়া যায় নি। রবীন্দ্রনাথ যে জগত সৃষ্টি করেছেন, তার বাইরে যাওয়া মুস্কিল। ধর্মের  সারকথায় সমর্পণের কথা আছে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের চেয়ে নিজেকে নিঃস্ব করে সমর্পণ করতে পেরেছে? তিনি বলেছেন, আমি মারের সাগর পাড়ি দেব। ‘মার’ কে? ‘মার’ হল কামনা-বাসনার দেবতা-রতিদেব। পৃথিবী এসবে ভরা। আবার দেখতে পাচ্ছি মৃত্যু আসছে দিনান্ত বেলায়।
রবীন্দ্রনাথের সমালোচনা কি হবে না? অবশ্যই সমালোচনা হতে পারে, হবেও। যে মত তিনি প্রকাশ করেন নি, সুপ্ত রেখেছেন তা নিয়ে সমালোচনা হতে পারে, আবার যে মতটি তিনি প্রকাশ করেছেন তা নিয়েও সমালোচনা হতে পারে। চাইলে বহুকিছু নিয়েই সমালোচনা করা যেতে পারে। এ-সমালোচনাগুলো আমার কাছে অবান্তর মনে হয় এ-কারণে যে, রবীন্দ্রনাথ যা-ই হোন না কেন সবটুকু যদি মানুষ ছাড়া তিনি অন্য কোনো কিছু হতেন তবে আমাদের কাছে তাঁর কোনও মূল্য থাকত না। সেজন্যই সত্যি কথা বলতে কি, আমি প্রলুব্ধ হই বুঝতে যে মানুষ কি একা জন্মায়? সারা জীবনব্যাপী তার কী একেবারেই কারো সঙ্গে যোগাযোগ হয় না? তার দেহের মধ্যে যে মন বা আত্মা শত চেষ্টাতেও কারো সঙ্গে তা মিশে তো যাবে না? দৈহিক সান্নিধ্য  তা এনে দিতে পারে যতোটাই আস্টেপৃষ্ঠে জড়ানো থাকুক না কেন। না-মানুষের সীমা এখানেই। প্রতিভাবানদের জন্য এ আরও সত্যি। অর্থাৎ তাঁরা পরাস্ত করে কথা ও অভিপ্রায়কে।

কতো তর্ক বিতর্কের বন্যা বয়ে গেছে ইউরোপ কখনই রবীন্দ্রনাথকে গ্রহণ করেছে কিনা! সেই ১৯১০ এ গীতাঞ্জলি  বের হল, রবীন্দ্রনাথ অনুবাদ করলেন। ইয়েটস সেখানে কিছু সম্পাদনা করলেন। সেগুলি ঠিক কি ছিল আমি এতদিন জানতাম না। সম্প্রতি হাসান ফেরদৌসের একটি বই বেরিয়েছে, সেখানে রবীন্দ্রনাথের মূল অনুবাদ একপাশে আর অপরপাশে কলাম ধরে ধরে তাঁর সংশোধিত অনুবাদ দেওয়া আছে। সেখানে বলে দেওয়া আছে যে, গোটা গীতাঞ্জলিতে সংশোধিত শব্দের সংখ্যা হল ২৪০ টি। আবার সেগুলো সব বাক্য নয়, বাক্যাংশ কিংবা দুই একটি শব্দের ব্যবহার নিয়ে, পোস্টমডার্ন-রা বলতেই পারেন যে রবীন্দ্রনাথের মনটা কলোনিয়াল। কিন্তু লক্ষ করলে দেখি, বিদেশি দ্রব্য পুড়িয়ে ফেলা, বিদেশী পণ্য বর্জন, দৈবে বিশ্বাস করা কি হিংসার আশ্রয় নেওয়া সে গান্ধী হোক আর যেই হোক তিনি সমর্থন করতেন না। তিনি দেখিয়ে দিচ্ছেন, তাঁর ঘরে বাইরেতে, যে হাটে বিলেতি পণ্য পুড়িয়ে দেয়া হচ্ছে সে হাটের অধিকাংশ দোকানদার মুসলিম। এরা তবে কি খেয়ে বাঁচবে? এতে কী লাভ হবে? এতেই কি ইংরেজ চলে যাবে? যখন জালিয়াওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড হল, রবীন্দ্রনাথ বার বার চিত্তরঞ্জন দাশের কাছে গিয়েছেন, এবার কংগ্রেস থেকে একটু প্রতিবাদ করুন। সম্ভবত গান্ধীর কাছেও বলেছেন। গান্ধী উপোস করা ছাড়া আর কিছু করেন নি। শেষ পর্যন্ত মধ্যরাত্রি পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথ পায়চারি করেছেন, শেষ পর্যন্ত স্থির সংকল্পে নাইট উপাধি বর্জন করেছেন। এ-নিয়ে তাঁর চিঠিটা পড়লে বোঝা যায় কতটা কঠিন, কতটা দৃঢ়ভাবে তিনি তাঁর কথাগুলি বলেছেন। গ্রহণ যা করব তা থেকে সরে না আসা, অথবা যা গ্রহণ করার তাকে একান্তভাবে নিজের করে নেওয়া। তিনি বলেছেন, ‘আমরা স্বদেশের কলাপাত্রে বিদেশের ভোজ্য খাইব’। কিছুদিন আগে আমি একটি প্রবন্ধ লিখেছি ‘একবিংশ শতাব্দীতে রবীন্দ্রনাথ’। তাতে মূলত বলতে চেয়েছি, রবীন্দ্রনাথ কী একবিংশ শতাব্দীতে কোনোভাবেই প্রাসঙ্গিক নন? যদি না হন তবে কেন নন? বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত -আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি এই গানটির ভিতরে ছবি আর বর্ণনা ছাড়া আর তেমন কিছু নেই। চোখ বন্ধ করে গাইতে থাকুন, তবে ছবির পরে ছবি আসবে, ‘বটের মূলে’, ‘নদীর কূলে’-একটানা বর্ণনা আর ছবির পর ছবি আর হৃদয় নিংড়ানো গভীর ভালবাসা। অহংকার আর গর্বে ভরা ‘ধনধান্য পুষ্পে ভরা আমাদের এই বসুন্ধরা’ নয়, ‘সার্থক জন্ম আমার/ জন্মেছি এই দেশে’। ‘কোন দেশেতে ওঠে গো চাঁদ এমন হাসি হেসে।’ কী অসাধারণ চিত্র! কিন্তু যে জাতি রবীন্দ্রনাথের গানকে জাতীয় সংগীত করেছে, তার কোথাও কী এই চিত্রগুলো আছে? নদীগুলো বেঁচে কী আছে? বটের মূল, বটের ছায়া কী আছে? দেশের সেই কুমারী বা পূর্ণযুবতী প্রকৃতি কী আছে? কিচ্ছু নেই। আমরা  এতভাবে নষ্ট করেছি, নষ্ট হয়েছি, বদলে গিয়েছি, ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। এ-বদলানো আমাদের নিজেদেরই। মোটামুটিভাবে পশ্চিমি বদলানো। আমরা এটা সম্পূর্ণভাবে নিচ্ছি বা নিতে বাধ্য হচ্ছি। বর্তমানে আমেরিকা জিএসপি সুবিধা দিচ্ছে না বলে, আমরা হা-হুতাশ করছি। এ কারণে খাদ্যে, পোশাকে, চলনবলনে শ্রেণিগত বৈষম্য এতটা বেড়েছে যে বলে শেষ করা যাবে না।

ঢাকায় আমরা সাঁওতাল সংস্কৃতির ছাপ খুঁজে পাব না। কোনো কিছুই অবশিষ্ট নেই। কিন্তু আমাদের  তো দেখানো দরকার বাঙালি কী ছিল? সাঁওতাল সংস্কৃতি কেমন হয়? আমরা এখন প্রাণ থেকে বিচ্ছিন্ন, জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন। তাহলে সমগ্র জাতি কী রবীন্দ্রনাথের সাথে ভণ্ডামি করছে? নজরুলের সাথেও করছে? নজরুলের সাথে হেফাজতের তের দফা যদি মেলাই ভয়ংকর চিত্র উঠে আসে। মেলে না কিছুই। এই জাতি বায়ান্ন, বাষট্টি, ঊনসত্তুর, একাত্তর পার করেছে। এ-তথ্যে তো কোনও ভুল নেই। তারপরও এ চিত্র। তাহলে রবীন্দ্রনাথ তো একদিক থেকে বাতিল হয়েই গেছেন। ব্যান্ডের গান শুনি, কণ্ঠ বলে কোনও বস্তু নেই। গভীর কণ্ঠস্বর বলে কোনও বস্তু নেই। গানের কথা বলেও কোন বস্তু নেই। যে কোনও বস্তু দিয়ে গান হতে পারে। কিছুদিন আগে বিচ্ছিরি কথা দিয়ে গান হত। আজকাল ব্যান্ডের আয়োজন মাঝে মাঝে দেখি। প্রথম কথা হচ্ছে, গান গাওয়ার আয়োজন যখন মঞ্চে হয়, তখন মনে হয় এখান থেকে কখন দৌড়ে বেরিয়ে যাব। গানের কথা, সুর নেই, কী বলছে তা নিজেই জানে না। তা-ও ঠুনকো এ-সৃষ্টি যদি নিজের হত, তবে একটা কথা ছিল। নকল সৃষ্টি। হয় তা হিন্দি মার্কা, নয়তো মার্কিন মার্কা ঋষভ চিৎকার। মার্কিনিরা কোথা থেকে নিয়েছে? জীবন থেকে নিয়েছে। আফ্রিকার প্রকৃতি থেকে ধার করেছে। আফ্রিকার জীবন থেকে নিয়েছে। স্বরটা  যেন সিংহের গর্জন। তাদের জীবন তো অন্যরকম। শিকারী জীবন হওয়ায় পশু হত্যা করতে হত, লড়াই করতে হতনানান রকম আচারে তারা মগ্ন থাকত। এগুলো তাদের জীবনের অংশ।
বাংলাদেশে আজ তার শিল্পসংস্কৃতি জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন। রবীন্দ্রসঙ্গীত কিছুতেই পৌঁছুবে না সাধারণ মানুষের কাছে। কারণ, সাধারণ মানুষ তো তৈরি করে নিতে হয়, সেটা করে রাষ্ট্র। রাষ্ট্র সেটা করছে না। সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল আলাদা হয়ে যাচ্ছে। উচ্চবিত্ত যারা তারা আলাদা। মধ্যবিত্ত যারা তারাই আলাদা হয়ে যাচ্ছে। সংস্কৃতি শিল্পসাহিত্য সৃষ্টি, ভোগ উপভোগ করছে। ধনিক শ্রেণি সংস্কৃতিহীন কিংবা সংস্কৃতি-স্বাধীন। এসব তাদের লাগে না।

কিন্তু এ-শ্রেণি সৃষ্টি হয়েছিল ইউরোপের সামন্ত-রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে। বিপ্লব করে। এরপরে পুঁজিবাদ পূর্ণ-বিকশিত হল। আমাদের এখানে বিকাশটা সেভাবে হয় নি। আমদের এখানে কাউকে দু-তিনটে টাকা দিয়ে ভোট চাওয়া যায়। ইউরোপে কী তা সম্ভব? তা নয়। তারা পৃথিবীর দেশে দেশে উপনিবেশ স্থাপন করেছে, শাসন করেছে -কিন্তু নিজের দেশটাকে মোটামুটি একটা উপযুক্ত স্থানে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে। একসময় রাশিয়াতে তলোস্তয় ছাপতে পারত না। কী করে ছাপবে? কারণ সবাই পড়তে জানে। ছাপতে গেলে রাষ্ট্রের কোষ শূন্য হয়ে যাবে। অত ছাপাবার পয়সা কোথায়? একশত ভাগ লোক শিক্ষিত এবং তলোস্তয় বোঝার মত লোকেরও অভাব নেই। তাহলে, বাংলাদেশে রবীন্দ্রনাথ কে পড়বে বা শুনবে সেটা একটা প্রশ্ন? যে নারী একসময় তানপুরায় গান করতেন, তিনি এখন নানারকম বাদ্যযন্ত্রে মগ্ন। চ্যানেলে চ্যানেলে দেখি একই গানে যে কতবার পোশাক পরির্তন করার প্রয়োজন পড়ে, তার ঠিক নেই। একবার নদীর পাড়, একবার পুকুর ঘাট, একবার বৃক্ষমূলে ঠেস দিয়ে। রবীন্দ্রনাথ প্রাসঙ্গিক শুধুমাত্র সংস্কৃতিগর্বীদের উপভোগের দ্রব্য! নদীর কূল, বটের মূল দ্রুত উবে যাচ্ছে।

আমি ৫৪ সালে এ-দেশে এসেছি। তখনও কিছু ছিল। আমি বলতে পারি গ্রামের কথা, ভৈরব রূপসা কপোতাক্ষের কথা। পদ্মা যমুনা মেঘনা তো আছেই। এখন আমাদের সমাজে শোষণ তুঙ্গে উঠেছে, অন্যায়-অত্যাচার বেড়েছে, আমরা হারিয়ে যাচ্ছি। এখন নদীখেকো, বালিখেকো, ভূমিখেকো, পাহাড়খেকোদের সময়। এখন যদি ঠিক পথের কথা বলতে চাই, তাহলে সাথে-সাথে আখ্যা  পেয়ে যাবে যে এই যে এক গলিত-শাসিত পুরোনোপন্থী। এখন বৃথা। সুতরাং রবীন্দ্রনাথ আর চলে না।
আমার মনে হয়, এই কবিই শ্রেষ্ঠ বাংলা উপন্যাসটি লিখেছেন। তা হল গোরা। তার প্রসার, ব্যাপ্তি, মানবিকতার অনন্যরূপ, সেই মাপে আমরা এখনও কিছু পাইনি। সুতরাং রবীন্দ্রনাথ কেবল কবিত্ব করেছেন, আমি মানি না। তবে বর্তমানের কথা যদি বলি, তাহলে দেখবো ইউরোপের দৃষ্টি রবীন্দ্রনাথের উপর পড়েছে। কিন্তু এখন শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির যে জায়গায় ইউরোপ পৌঁছে গেছে, তাতে রবীন্দ্রনাথ খুব আলোচ্য হবে না। তিনি বড়জোর দূরের একটি জ্যোতিষ্ক। এটা ঘটে গেছে। সুতরাং একবিংশ শতকে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে শেষ কথা আমরা বলতে পারব না। এখন অনেকে তাঁকে বড় বলছে। মহান বলছে। তার পরিচয় হচ্ছে গ্রেট পোয়েট। রিডার্স ডাইজেস্ট গল্প সংকলন বেরিয়েছে, গ্রেট শর্ট স্টোরিজ অব দি ওর্য়াল্ড-সেখানে তাঁর স্থান হয়েছে। আমরা তাঁর শিক্ষাচিন্তা-সাহিত্যচিন্তা-সমাজবোধ-সংস্কৃতিচেতনা থেকে যা নিতে পারতাম তার সবটাই বর্জন করেছি। একবার সমস্ত রবীন্দ্রনাথ পড়ার জন্য সঞ্চয়িতা পড়তে শুরু করলাম। দেখলাম, এভাবে সম্ভব নয়। মহাকাব্য একটানে পড়া যায়, কিন্তু রবীন্দ্রনাথ নয়। রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প আমাকে খুব টানে। কিন্তু আমি নিজে সযত্নে তাঁর পথকে ত্যাগ করেছি। আসলে কোথায় রবীন্দ্রনাথকে গ্রহণ করব, বর্জন করব আমি এত ভাবি না। কারণ আপনা থেকেই রবীন্দ্রনাথ পাঠ্য হয়ে ওঠেন । বলে দেওয়া, বা দেখিয়ে দেবার দরকার নেই। ইউরোপের দর্শন আমি কিছু পড়েছি, আধুনিক দর্শনও। কিন্তু বাতিলের মনোভাব নিয়ে কিছু কখনও পড়ি নি।

একটা গল্প বলেই শেষ করবো। হ্বিটগেনস্টাইন বিংশ শতাব্দীর এক সেরা ভাষার সীমানা নির্ধারক লজিশিয়ান। তিনি সরাসরি বার্টান্ড রাসেলের ছাত্র ছিলেন। ম্যাচিয়্যুরড হয়ে বললেন যে, ‘রাসেলকে তাঁর পুরনো চিন্তায় পেয়ে বসেছে-তিনি আর ওখান থেকে বেরুতে পারছেন না।’ হ্বিটগেনস্টাইনের চিন্তা একটা ধারায় এগুলো, মধ্যবয়সে ভিয়েনা সার্কেলের পুরনো বন্ধুদের কাছে গেলে বন্ধুরা বললো Latest logical positivism নিয়ে কিছু বলতে। তখন তিনি করলেন কী--‘রাজা’ নাটকের একটি অংশ ইংরেজি অনুবাদে পড়ে শোনালেন-King of dark chamber  থেকে তারপর আর কিছু বললেন না!
মানুষ ততটাই চিন্তা করতে পারে যেখানে তার ভাষা পৌঁছায়, যেখানে ভাষা আর যায় না ওখানে Silence--এই হল তাঁর মূল বক্তব্য। আসলে আমরা সবটাই ভাষিক, আমাদের নির্মাণটা ভাষিক, আমাদের অস্তিত্বটাও ভাষিক। ঠিক আছে? আমরা পরস্পর যে বেঁচে আছি তা আমদের ভাষা না থাকলে বুঝতে পারতাম না। বুঝতে পারলেও প্রকাশ করতে পারতাম না।
তাহলে আমাদের সীমা কোথায়? ভাষার সীমা। তারপরে আমরা আর নেই। রবীন্দ্রনাথ কী ভেবেছিলেন, ভাষাহীন কোনকিছু আছে কিনা!
ইউরোপের কোন কোন মানুষকে রবীন্দ্রনাথ এভাবে টেনেছেন। চীনে প্রচুর লেখক সে-সময়ে তাঁর অনুসারী ছিল, জাপানেও ছিল, মোট কথা যে, রবীন্দ্রনাথ হলেন সমস্ত পৃথিবীর বাসিন্দা। এর মধ্যের বিরাট একটা অংশ তাঁকে বুঝবে না, নেবেও না কোনদিন। বিরাট অংশ বুঝেও বুঝবে না। আর আমরা তো বেশির ভাগই সুখাদ্য খেয়ে অজীর্ণ হয়ে তাকে বর্জ্য হিসেবে বের করে দিতে বাধ্য হই!








আনিসুজ্জামান 
রবীন্দ্রনাথ : আমার এবং সকলের

বাংলাভাষীদের কাছে রবীন্দ্রনাথের অব্যাহত প্রভাব-প্রতিপত্তি অন্যদের কাছে বিস্ময়কর মনে হতে পারে। যাঁরা তাঁকে বাঙালি সংস্কৃতির শ্রেষ্ঠ নির্মাতা বলে জানেন, তাঁদের কাছে বিষয়টা স্বাভাবিক বলেই বিবেচিত হবে। বাংলা ভাষাকে যে ঐশ্বর্য তিনি দান করেছেন, তাতে এই ভাষা জ্ঞানবিজ্ঞানের চর্চা, সকল ভাব-অনুভূতির প্রকাশ এবং নির্মল হাস্যকৌতুকের বাহন হতে সমর্থ হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের আগেও বাংলায় কবিতা ছিল, তবে পদ্য ও কবিতার পার্থক্য আমরা বুঝতে শিখেছি তাঁর লেখা পড়েই। বাংলা ছোটগল্পের ¯্রষ্টা তিনি, বাংলা উপন্যাসের গতিপথ-নির্মাতা। নাটক ও গীতিনাট্য, সাহিত্য-সমালোচনা ও ভাষাতত্ত্ব, ইতিহাস ও বিজ্ঞান, চিঠিপত্র ও ভ্রমণকথা- সবক্ষেত্রেই তাঁর দান অনন্য। তাঁর সংগীতে সমীকৃত হয়েছে কথার বৈচিত্র্যের সঙ্গে ভারতীয় ধ্রুপদী, বাংলা কীর্তন, বাউল ও লোকসংগীত এবং পাশ্চাত্য সংগীতের সুর। নৃত্যনাট্য নামের শিল্পটি তাঁরই উদ্ভাবন। পরিণত বয়সে চিত্রকলার যে-চর্চা তিনি করেন, তার অভিনবত্ব ও গভীরতা সকল সমালোচককে বিস্মিত করেছে। বারবার তিনি নিজেকে ছাড়িয়ে গেছেন। তাঁর ভাবনা বারবার নতুন বাঁক নিয়েছে। ঈশ্বরে সমর্পিত তাঁর গান নাস্তিকেরও উপভোগ্য, আবার তিনিই বলেছেন, ‘ধর্মকারার প্রাচীরে বজ্র হানো’। মানবসভ্যতার যা কিছু বরণীয়, তাকেই গ্রহণ করেছেন তিনি, অকুণ্ঠচিত্তে আহরণ করেছেন কাছে-দূরের নানান সংস্কৃতি থেকে।

এর বাইরেও রবীন্দ্রনাথ আছেন। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা যিনি নেননি, তিনিই হয়ে ওঠেন স্মরণীয় শিক্ষাতাত্ত্বিক, গড়ে তোলেন বিদ্যালয়, তাকে রূপ দেন বিশ্ববিদ্যালয়ে। মাতৃভাষাকে শিক্ষার বাহন করে নেন। পল্লী-পুনর্গঠনে তাঁর প্রয়াস অতি শ্রদ্ধেয়। কৃষি ও কুটির শিল্পের বিকাশে এবং এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মানুষের ভাগ্যোন্নয়নে তাঁর প্রচেষ্টা অবিস্মরণীয়। যন্ত্র দিয়ে চাষের পরীক্ষা করেছেন, তাঁতিদের জন্যে প্রতিষ্ঠা করেছেন বয়ন-বিদ্যালয়, চাষিরা যাতে সহজে ঋণ পায় তার জন্যে স্থাপন করেছেন কৃষিব্যাংক। শ্রীনিকেতনের সবটাই তাঁর এই পুনর্গঠন-প্রক্রিয়ার নমুনা। একসময় রাজনীতিতে তিনি যোগ দিয়েছেন সোৎসাহে, আদর্শগত কারণে পরে সরেও এসেছেন। তবে দেশবাসীর আত্মনিয়ন্ত্রণের দাবি কখনো ত্যাগ করেননি। জালিয়ানওয়ালাবাগের নির্মমতার প্রতিবাদ করতে যখন এগিয়ে আসেননি কোনো রাজনীতিবিদ, তখন তিনি ‘নাইট’ উপাধি ফিরিয়ে দিয়ে নির্যাতিত মানুষের কাতারে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। রাজনৈতিক কর্মপন্থা নিয়ে প্রকাশ্যে তিনি তর্ক করেছেন- যাঁকে তিনিই অভিহিত করেছিলেন মহাত্মা বলে, তাঁর সঙ্গে এবং রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক বিষয়কে ধর্মের সঙ্গে জড়িত করার বিরুদ্ধে সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছেন। তিনি রাজনীতিবিদদের আহ্বান করেছিলেন জনমুখী হতে, জনসভায় বাংলাভাষায় বক্তৃতা দিতে, হিন্দু-মুসলমানের মিলনসাধনে চেষ্টিত হতে। উত্তুঙ্গ জাতীয়তাবাদের দিনেও তিনি বলেছিলেন, এ-দেশের ইতিহাসে ইংরেজের একটা স্থায়ী আসন আছে। তিনি উন্নয়নের কথা ভেবেছেন, সম্পদের সুষম বন্টনের কথা বলেছেন এবং নারীর জন্য দাবি করেছেন ন্যায্য স্থান।

তারপরও আছে। সারা পৃথিবীকে মানবতার বাণী শোনাবার স্পর্ধা করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। নোবেল পুরস্কার পাওয়ার সময়েই তাঁর মনে হয়েছিল পৃথিবীতে এক প্রবল ঝড় আসন্ন। এর জন্যে তিনি দায়ী করেছিলেন অন্যের সম্পদ গ্রাসে ইউরোপের অপরিসীম লালসাকে। বলেছিলেন, জাতীয়তাবাদ একই সঙ্গে বিধ্বংসী ও আত্মঘাতী। শুধু ইউরোপে ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নয়, চীন ও জাপানেও রবীন্দ্রনাথ আগ্রাসী জাতীয়তাবাদের নিন্দাজ্ঞাপন করেন এবং প্রায় সর্বত্রই প্রত্যাখ্যাত হন।

আশি বছরের জীবনে রবীন্দ্রনাথ ভুলও করেছেন যথেষ্ট। তাঁর কথার মধ্যে, কাজের মধ্যে পরস্পরবিরোধী উপাদান খুঁজে বের করা শক্ত নয়। দীর্ঘকালের সৃষ্টিশীল জীবনে তা অপ্রত্যাশিত নয়। কিন্তু তাঁর ক্ষেত্রে দেখা গেছে যে, ভ্রান্তিজাল কাটিয়ে খানিক পরেই তিনি উঠে দাঁড়িয়েছেন সত্য ও ন্যায়, শুভ্র ও কল্যাণের পক্ষে। তাঁর ভ্রান্তি থেকেও আমাদের শেখার আছে। রবীন্দ্রনাথ ছাড়া তাই আমাদের চলে না।

রবীন্দ্রনাথ আমাকে দিয়েছেন আত্মপ্রকাশের ভাষা, জীবনকে উপভোগ করার উপকরণ। তিনি আমাকে দিয়েছেন দেশকালের ঊর্ধ্বে যে-বিশ্ব, তার পথিক হওয়ার প্রেরণা। তিনি আমাকে শিখিয়েছেন সকল মানুষকে ভালোবাসতে। তিনি আমাকে দিয়েছেন অন্যায়ের প্রতিবাদ করার মন্ত্র। তাঁর হাত ধরে পথ চলতে চেষ্টা করি আমি।      



















আব্দুল্লাহ আল মামুন
আমার রবীন্দ্রনাথ


আমার রবীন্দ্রনাথ? কোন অর্থে? রবীন্দ্রনাথে আমার কি অধিকার? কিংবা কতটুকু গর্ব বা আনন্দের? আমার ভাষা, আমার দেশ, আমার বাঙালি জাতিসত্তা এগুলোর সঙ্গে যে রবীন্দ্রনাথ অনিবার্য তার কতটুকু ধারণ করি আমি? কিংবা একজন শিল্পী হিসেবে যে রবীন্দ্রনাথ, একজন গীতিকার বা সঙ্গীতজ্ঞ, একজন সাহিত্যিক, একজন শিক্ষাবিদ, সমাজকর্মী, দার্শনিক, রাজনীতিক, সর্বোপরি একজন কবি হিসেবে তার যে পরিচয় তার কোন্টির সঙ্গে আমি সম্পর্কিত বা কোনটিতে আমার অধিকারজ্জএসব প্রশ্নগুলোর মুখোমুখি হয়ে এই প্রথম বুঝতে পারলাম এর কোনটিতেই আমার কোন অধিকার নেই, আর তাই রবীন্দ্রনাথেও আমার কোন অধিকার নেই। ‘আমার রবীন্দ্রনাথ’ বলে কিছু হতে পারে না।

আমরা বলি আমার আকাশ, আমার বাতাস। আমার দেশ, আমার ঐতিহ্য। আমার ভাষা, আমার বর্ণমালা। আমার ঘটিবাটি, থালাবাসন, আমার বিত্তবৈভব- এই যে অধিকার-প্রবণতা, এই যে বিষয়-বাসনাজ্জএরই অংশ হিসেবে আসে ‘আমার রবীন্দ্রনাথ’। সে রবীন্দ্রনাথ আমার ক্ষুদ্রতা ও হীনতা, আমার সীমাবদ্ধতা ও অজ্ঞতায় পিষ্ঠ ও বিকৃত এক ‘আমার চেয়েও ছোট’ সম্পত্তি-ধারণা। এ রবীন্দ্রনাথ বড় এক বোঝা, ভীষণ অপ্রয়োজনীয় আর অনন্ত লজ্জার।

এছাড়া এর বিকল্প এক ভঙ্গি প্রতিষ্ঠা করা যায় সমাজবাস্তবতার নিরিখে আমার প্রয়োজন ও উপযোগিতার আলোকে রবীন্দ্রনাথকে পাঠ্য-বিবেচনায় এনে। রবীন্দ্রনাথ কিভাবে রবীন্দ্রনাথ হয়ে উঠলো, কতটুকুই বা তার শিল্পী হিসেবে, কবি হিসেবে প্রাপ্য, আর কতটুকুই বা আমরা তাকে আরোপ করেছিজ্জরবীন্দ্রনাথ জমিদারের সন্তান না হলে কিংবা তৎকালীন ইংরেজরাজের সাথে সুকৌশলী সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা না করলে, তার প্রতিষ্ঠায়নের বা ‘দেবায়নের’ প্রক্রিয়া ও সাফল্য কতটুকু কি পদ্ধতিতে ঘটতো, সে সবের বুদ্ধিদীপ্ত বিশ্লেষণ ও সংশ্লেষণের মাধ্যমে তার ব্যাপারে একটি সিদ্ধান্ত ও মূল্যায়ন প্রতিষ্ঠা পেতে পারে। এ পদ্ধতিতে সামনে আসতে পারে তার জীবনের অসংখ্য ঘটনা : কি ভীষণ শঠতা ও কূটচালের মাধ্যমে তিনি নিজে ও তার পরিবারের সদস্যরা (বিশেষ করে তার দেবতুল্য বাবা মহর্ষি দেবেন ঠাকুর) তার অবৈধ সম্পর্ক ও তার পরিণতিতে কাদম্বরী দেবীর আত্মহত্যাকে সামাল দেন; সহমর্মিতা ও সমানাধিকারের সুকৌশলী আবরণে কিভাবে প্রজাসাধারণকে শোষণ করেন; বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলনে সরাসরি অংশগ্রহণের মাধ্যমে বাঙ্গালি মুসলিমদের অধিকারের বিষয়ে চরম অবজ্ঞার প্রকাশ ঘটান; ‘নাইট’ উপাধি বিসর্জনের মাধ্যমে যে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ফায়দা লোটার চেষ্টা করেন; ওকাম্পোর সাথে বুড়ো বয়সে এসে যে সম্পর্ক প্রতিষ্টার উদগ্র চেষ্টা করেও বিফল মনোরথ হন ইত্যাদি। ব্যক্তি রবীন্দ্রনাথকে ঐতিহাসিক বাস্তবতার আলোকে ও নিজের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে পাঠের এ ভঙ্গি বেশ মজাদার, আমাদের দেশে বেশ জনপ্রিয় ও ফলদায়ক। কিন্তু ব্যক্তি রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে এ বিশ্লেষণী আয়োজন, কখনো কখনো যা বেশ খানিকটা কদর্যও বটে, তার সৃষ্টিকর্মের মূল্যায়ন নয় বিধায় এ রবীন্দ্রনাথের সাথেও আমার কোন সম্পর্ক নেই।

‘আমার রবীন্দ্রনাথ’ বলতে তৃতীয়  আরেকটি বিকল্পও দাঁড় করানো যায়। তার চিন্তা-ভাবনা, তার বিভিন্ন সামাজিক কর্মকা-, তার সৃষ্টিকর্মসমূহের নিবিড়পাঠের মধ্যে দিয়ে তার সঙ্গে একান্ত ব্যক্তিগত এক সম্পর্ক গড়ে তোলা, নিজেকে উন্মুক্তভাবে তার কাছে সমর্পণের মধ্য দিয়ে তাকে নিজের মধ্যে অন্তহীনভাবে প্রবেশ করতে দেয়া। এ সম্পর্ক অধিকারের নয়, এ সম্পর্ক ভালবাসার, এ সম্পর্ক কৃতজ্ঞতাসিঞ্চিত একীভূত হবার, এ সম্পর্ক নিজেকে উজাড় করে দেবার; কিন্তু এ সম্পর্ক ভীষণ ভীতিকরও বটে, এ সম্পর্ক সকল নিয়ে সর্বনাশের আশায় বসে থাকা, এ সম্পর্ক নিজের সবকিছুকে উৎসর্গ করে তার দেবালয়ের প্রদীপ হবার বাসনার। আর তাই এ সম্পর্ক পুজারও বটে। আমার এ ছোটখাটো কোনোমতে টেনে চলা জীবনে, যা অন্তহীনভাবে হীনদের অনুকম্পাপ্রার্থী ও অনুবৃত্তির আবর্তে আবর্তিত, পুজা করবার অবকাশ কোথায়? বড়জোর প্রার্থনায় হয়তো বা নত হতে পারি যা উজাড় করে দেবার নয়, হীন বাসনা চরিতার্থের প্রার্থনা। তাই বুঝতে পারি ভালবাসলে সে নাড়া দিতে পারে, এনে দিতে পারে প্রভাতের রবির কর, প্রবেশ করতে পারে গুহার আঁধারে প্রভাত পাখির গান, কিন্তু সে ভালবাসার শক্তি কই, সাহস কই?
মাঝে মাঝে এই শক্তি ও সাহসের বাসনা মনে জাগে। মনে হয় একবার যদি তার সাথে এ সর্বনাশের মরণখেলায় নামতে পারতাম :

মরণদোলায় ধরি রশিগাছি
বসিব দুজনে বড়ো কাছাকাছি,
ঝঞ্ঝা আসিয়া অট্ট হাসিয়া মারিবে ঠেলা,
আমাতে প্রাণেতে খেলিব দুজনে ঝুলনখেলা
নিশীথবেলা।


তাহলে তাকে চিনে নিতে পারতাম বক্ষশোণিতের হিল্লোলে কল্লোলে। আধমরা এ জীবনকে ঘা দিয়ে জাগিয়ে তুলতে পারতাম জীবনের জয়গানে, খুলে যেত আপনারে দিয়ে রচিত আপনার আবরণ-আগল, চিনে নিতে পারতাম অন্তরের আনন্দনিকেতন। হীনতা ও নীচতার সব সীমা ছাড়িয়ে গেয়ে উঠতে পারতাম তার সাথে জীবনের জয়গানে। ভয়শূন্য চিত্তে উচ্চশিরে গেয়ে উঠতে পারতাম ‘জয় হোক জীবনের, জয় হোক মানবের।’
কিন্তু এ জয়গানের জন্য যে প্রজ্ঞা ও প্রস্তুতি দরকার তা আমার নেই। মহানভ-অঙ্গনে উষা-দিশাহারা নিবিড়-তিমির-আঁকা যে পথ সে পথে একাকী মহা-আশঙ্কা জপিত মৌনতায় উড়বার ক্ষমতা কোথায়? কষ্টের বিকৃত ভান, ত্রাসের বিকট ভঙ্গীতে বিশ্বাস আমার, আর তাই পদে পদে হয় অনর্থ পরাজয়। আর তাই এই হারজিত খেলা, জীবনের মিথ্যা এ কুহক।

শিশুকাল হতে বিজড়িত পদে পদে এই বিভীষিকা,
দুঃখের পরিহাসে ভরা।
ভয়ের বিচিত্র চলচ্ছবিজ্জ
মৃত্যুর নিপুণ শিল্প বিকীর্ণ আঁধারে।

ভয় ও দুঃখের বিচিত্র ছলনাজালে বিস্তৃত মিথ্যা বিশ্বাসের ফাঁদে অন্তহীন আত্ম-সমর্পণের একটি বড় কারণ শুভবোধকে, মঙ্গলচেতনাকে ধারন করতে না পারা; জীবনে যে মহত্ত্ব আছে, অনন্ত যাত্রার অনিঃশেষ অধিকার আছে তাকে স্বীকার না করা। এই অক্ষমতা অন্তরের পথকে করে কলুষিত, সহজ বিশ্বাসের চিরস্বচ্ছ চিরসমুজ্জল সত্য ও স্বাধিকারের ঋজু পথকে করে বিড়ম্বিত। পরম নির্ভরতায় রবীন্দ্রনাথের সাথে তাই বলতে পারি না :

সত্যেরে সে পায়
আপন আলোকে ধৌত অন্তরে অন্তরে।
কিছুতে পারে না তারে প্রবঞ্চিতে,
শেষ পুরস্কার নিয়ে যায় সে যে
আপন ভাণ্ডারে।
অনায়াসে যে পেরেছে ছলনা সহিতে
সে পায় তোমার হাতে
শান্তির অক্ষয় অধিকার।


শান্তির অক্ষয় অধিকার লাভের বাসনা আছে, রবীন্দ্রনাথ হাত বাড়িয়ে অপেক্ষায়, কিন্তু হাতে হাত রাখা আর হয়ে উঠে না, রূপ-নারানের কূলে জেগে উঠতে পারি না আর, অনুধাবন করতে পারি না রক্তের অক্ষরে আপনার রূপ, চিনে নিতে পারি না আপনাকে আঘাতে আঘাতে বেদনায় বেদনায়। সত্য ও শান্তি আমার অধিকার, কিন্তু এ অধিকার লাভ কঠিন, আর এ অধিকার লাভের জন্য দরকার যে আমৃত্যু দুঃখের তপস্যা তা শুরুই করতে পরিনি কখনো, আর তাই এমনকি মনে মনেও কখনো বলে উঠতে পারিনি :

সত্য যে কঠিন,
কঠিনেরে ভালোবাসিলামজ্জ
সে কখনো করে না বঞ্চনা।
আমৃত্যুর দুঃখের তপস্যা এ জীবন-
সত্যের দারুণ মূল্য লাভ করিবারে,
মৃত্যুতে সকল দেনা শোধ ক’রে দিতে।

যা কিছু সত্য ও সুন্দর, যা কিছু ন্যায় ও শুভ, যা কিছু প্রেম ও পবিত্র, আর যা কিছু স্বাধিকার ও শান্তি তার প্রতিস্পর্ধী আমার কদর্যতা ও হীনতা, আমার অনুবৃত্তি ও শৃঙ্খল, আমার দায় ও পরাধীনতা আমাকে স্মরণ করিয়ে দেয় অচলায়তনের ভাঙ্গা হয়নি কিছুই, রবীন্দ্রনাথের সাথে যোগাযোগই ঘটেনি এখনো, ফলে হৃদয় খুঁড়ে আবিস্কার করা হয়নি ‘আনন্দলোকে, মঙ্গলালোকে বিরাজ সত্য সুন্দর’।
রবীন্দ্রনাথে আমার কোন অধিকার নাই।






মাসউদ আখতার
আমার রবীন্দ্রনাথ


‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি’-র কবি রবীন্দ্রনাথের সাথে পরিচয় হয়েছিল ‘ছুটি’-র আনন্দে : ‘মেঘের কোলে রোদ হেসেছে, বাদল গেছে টুটি/ আজ আমাদের ছুটি ও ভাই আজ আমাদের ছুটি।’ ‘গল্পগুচ্ছ’-র পুচ্ছ ধরে পরিচয় গড়ায় ঘনিষ্ঠতায়, উঠে পড়ি ‘সোনার তরী’-তে, স্বাদ পাই নানারকম রবীন্দ্রনাথের : ‘চোখের বালি’, ‘নৌকাডুবি’, ‘গোরা’, ‘চার অধ্যায়’, ‘রক্তকরবী’, অথবা ‘শেষের কবিতা’...। শোনা হয় গানের রবীন্দ্রনাথ। খুলে দেখি নোবেল মোড়ানো ‘গীতাঞ্জলি’-কেও। দেখা হয় সত্যজিত রায়-এর রবীন্দ্রনাথও : ‘ঘরে বাইরে’। তারপর? তারপর তো সে-ই চেনা বাঁক: ‘সেদিন চৈত্র মাস/ তোমার চোখে দেখেছিলেম আমার সর্বনাশ।’ সেই সুখের ‘সর্বনাশ’ যখন স্থায়ী হয় না তখনও ঐ রবীন্দ্রনাথেই সান্ত্বনা : ‘তবু মনে রেখো/ যদি দূরে যাই চলে/ যদি পুরাতন এ প্রেম ঢাকা পড়ে যায় নব প্রেম জালে/ তবু মনে রেখো।’

২.
বাঙালির প্রতিদিনের জীবনচর্যায় রবীন্দ্রনাথ তো প্রবলভাবেই দৃশ্যমান; বাঙালির আড্ডায়, উৎসবে, অনুষ্ঠানে, বাঙালির বিদ্যায়তনে তাঁর অবধারিত অবস্থান, সর্বব্যাপী তাঁর প্রভাববলয়। মৈত্রেয়ী দেবীর লেখা ‘ন হন্যতে’ বই-এ তাই অমৃতার ভিনদেশী বন্ধু মির্চা অমৃতার মুখে সারাক্ষণ কবিগুরুর বন্দনা শুনে উৎপীড়িত (?) হয়ে যখন বলল : ‘ঐ একজন লোকই কি তোমাদের সব কিছু করবেন?’ অমৃতা তখন সাথে সাথেই উত্তর দিয়েছিল : ‘হ্যাঁ তা-ই, হ্যাঁ তা-ই, ঐ একজন লোকই আমাদের আকাশ জুড়ে আছেন, আমাদের মুখে কথা দিচ্ছেন, আমাদের মনে ভালবাসা দিচ্ছেন, সে আছে বলে আমার আকাশ জুড়ে ফোটে তারা রাতে, প্রাতে ফুল ফুটে রয় বনে।’ উনিশ শ’ ত্রিশ দশকের সদ্য কৈশোর পেরুনো শহুরে শিক্ষিত বাঙালি পরিবারের মেয়ে অমৃতার কাছে কবিগুরু তো একজন সাক্ষাৎ ‘ঠাকুর’, স্বপ্নে দেখা প্রেমিক, তাঁর কাছেই অমৃতা নিবেদন করে তার সত্তা, কবিগুরুর কবিতা ও গান তার জগতের ছন্দ নির্ধারণ করে। তার অব্যক্ত আবেগ-অনুভূতি, স্বপ্ন-কল্পনা, উদ্বেগ-যন্ত্রনা, প্রেম-অভিমান, বিরহ-একাকীত্ব, মুগ্ধতা-আকুতি অবয়ব পায় কবিগুরুর গানে, গল্পে, কবিতায়। বর্ষার, প্রেমের কিংবা পুজোর গানে কবিগুরুর একান্ত ব্যক্তিগত বোঝাপড়া এভাবে রূপান্তরিত হয় সামগ্রিক উদ্যাপনের বিষয়বস্তুতে, বাঙালির সর্বজনীন অনুভূতি ও অভিব্যক্তিতে।

৩.
ইদানিং বেশি টানে রবীন্দ্রনাথের প্রবন্ধ; সমাজ ও রাষ্ট্র, শিল্প ও সাহিত্য, ধর্ম ও আধ্যাত্মিকতা প্রভৃতি বিষয়ে তাঁর লেখা-র সংকলনগুলোয় মনোযোগ দিতে চেষ্টা করি। ভাল লাগে ‘রাশিয়ার চিঠি’ বা ‘জাপান যাত্রী’-র মত তাঁর ভ্রমণ কাহিনিগুলোও। আলোড়িত হই, উদ্বুদ্ধ হই তাঁর প্রথাগত মুখস্ত সর্বস্ব শিক্ষার প্রত্যাখ্যানে; আবার স্থানীয়তা এবং বৈশ্বিকতাকে একসূত্রে বাঁধবার তাঁর সমন্বয়বাদী প্রয়াসে; কিংবা ‘ন্যাশনালিজম’, ‘রিলিজিয়ন অফ ম্যান’, ‘কালান্তর’, ‘সভ্যতার সংকট’ প্রভৃতি-তে উগ্র জাতীয়তাবাদ, সাম্রাজ্যবাদ, ধর্মান্ধতা, কুপমণ্ডুকতা, সামাজিক বৈষম্য ও অর্থনৈতিক বঞ্চনার বিরোধিতায় বিশ্বভ্রাতৃত্ব, মানবতাবাদ, আধুনিকতা ও প্রগতি-র স্বপক্ষে তাঁর উচ্চকিত, স্পষ্ট দার্শনিক অবস্থানে। আর হ্যাঁ, শুধু তাত্ত্বিক, দার্শনিক আলোচনা করেই তো তিনি ক্ষান্ত দেন নি, বরং সমাজকল্যাণ ও গ্রাম-উন্নয়ন, সমবায়, কৃষির উন্নতি, দরিদ্র-জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যসচেতনতা প্রভৃতি ইস্যুতে তিনি তাঁর নিজস্ব কর্মসূচি নিয়ে এগিয়ে এসেছেন।
এভাবে রবীন্দ্রনাথকে যেমন আমরা পাই প্রেম ও সৌন্দর্যের, রোমান্টিক অভিব্যক্তির কিংবা অধ্যাত্ম-চেতনার একজন অসামান্য কবি হিসেবে, সাথে সাথে তাঁকে আমরা পাই একজন অত্যন্ত বিচক্ষণ, বাস্তববাদী চিন্তাবিদ, এমনকি একজন সমাজ ও মানব-সংস্কারক হিসেবে। কথা হচ্ছে, এই চিন্তাবিদ, দার্শনিক ও সংস্কারক রবীন্দ্রনাথ অনেক সময়ই চাপা পড়ে যান; আপাত প্রীতিপ্রদ রোমান্টিক বাতাবরণে এই রবীন্দ্রনাথকে আমরা হয়ত আমাদের অজান্তেই আড়াল করে রাখি।
৪.
অক্সফোর্ড-প্রবাসী বাঙালি লেখিকা সুনেত্রা গুপ্ত-র স্মৃতিচারণমূলক একটা প্রবন্ধ পড়ছিলাম; ফরাসী আলোকচিত্রী বেনয়েট ল্যাঙ-এর ‘ক্যালকাটা’ নামক সংকলনের ভূমিকা হিসেবে সুনেত্রা ঐ লেখাটা লিখেছিলেন। সেখানে তিনি কলকাতার শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বাঙালির রবীন্দ্রচর্চ্চা-র ধরণ নিয়ে তাঁর হতাশার কথা জানিয়েছেন। তিনি মন্তব্য করেছেন যে, বাঙালিরা এক ধরণের সীমাবদ্ধ, আচারসর্বস্ব ও একপাক্ষিক বা আংশিক, ফলত নিষ্ফল রবীন্দ্রচর্চায় আটকা পড়ে আছে। বাঙালিকে নিয়ে রবীন্দ্রনাথের স্বপ্ন ছিল অনেক বড়; কিন্তু তাঁর ভক্তকুল এই মহান দার্শনিক-কবির সমাজ, রাজনীতি কিংবা শিক্ষা সম্পর্কিত গভীর দূরদৃষ্টি সম্পন্ন, বাস্তবজ্ঞান সম্বলিত দিক-নির্দেশনা ও দর্শন পাশে ঠেলে মোহগ্রস্থের মত প্রধানত তাঁর রোমান্টিক কিংবা আধ্যাত্মিক কবিতা ও গানের একরকম কৃত্রিম ও অতিরঞ্জিত চর্চ্চায় নিজেদের নিবিষ্ট রেখেছে; তাদের লেখনীতে, আলাপচারিতায়, প্রাত্যহিক জীবনচর্যায় এই অগভীর, অন্তসারশূন্য, আচার-ঘনিষ্ঠ ‘রাবীন্দ্রিক স্টাইল’ অনুসরণের প্রাণান্ত প্রয়াস লক্ষ করা যায়। আমরা বাঙালির ক্রমবর্ধমান সামাজিক, রাজনৈতিক, এমনকি অর্থনৈতিক বিপর্যয় এবং সাংস্কৃতিক দারিদ্র্যের পেছনে তার অসম্পূর্ণ বা একপাক্ষিক ও ‘অবাস্তব’ রবীন্দ্রচর্চ্চাকে একটা গুরুত্বপূর্ণ কারণ হিসেবে চিহ্নিত করব। এবং আশা করব বাঙালি তার সাংস্কৃতিক ধারায় এবং দৈনন্দিন জীবনে সামগ্রিক, পূর্ণাঙ্গ রবীন্দ্রনাথকে প্রতিপালন ও পরিচর্যা করবে।




হারুন-অর-রশীদ
সংগীতে রবীন্দ্রনাথ


রবীন্দ্রনাথ সাহিত্য-সঙ্গীতের মাধ্যমে সকল দীনতার অবসান ঘটিয়ে সুন্দর স্নিগ্ধ শান্তিময় এক পৃথিবী কামনা করেছেন, যা সকলের জন্য মঙ্গল ও সুখময়। আমরা বাংলা ভাষাভাষীরা গর্বিত এ কারণে যে, রবীন্দ্রনাথের মত এক মনিষী বাঙালির ঘরে জন্ম নিয়েছিলেন। বাঙালিকে বিশ্বের কাছে স্বমহিমায় পরিচিত করনোর দায়িত্ব তিনিই প্রথম নিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টিকর্মের মধ্যে গানই শ্রেষ্ঠ। ভারতীয় সঙ্গীতের বিপুল ঐতিহ্যের ধারায় বাঙালির চিরায়ত সঙ্গীত তিনি রচনা করেছেন। সমসাময়িক সংকটময় জীবনের বিপর্যয় কাটিয়ে মানুষের কল্যাণের পথে এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা তাঁর গানের মধ্যে খুঁজে পাওয়ার যায়।

রবীন্দ্রনাথের জন্মের পর দেড় শতাব্দীর পেরিয়ে গেল। তারপরেও দিবাকরের প্রজ্বল কিরণের মতই তাঁর অনন্য প্রতিভার আলো উদ্ভাসিত করে চলেছে বাঙালির জীবন ও মানস। নতুন চিন্তনে হৃদয়ের সুকুমার অনুভূতি প্রকাশে অনুভব করা যায় তাঁর প্রাসঙ্গিকতা। এজন্য তিনি শান্তি ও মানবতার কবি। প্রকৃতির চিরন্তন সৌন্দর্যের কবি। জীবন ও জগৎকে গভীরভাবে নিরীক্ষণ করেছেন তাঁর প্রতিটি সৃষ্টিতে। গল্প-উপন্যাসে, কবিতায়, প্রবন্ধে, নতুন সুরে ও বিচিত্র গানের বাণীতে, অসাধারণ সব দার্শনিক চিন্তাসমৃদ্ধ প্রবন্ধে, এমকি চিত্রকলায়ও রবীন্দ্রনাথ চিরনতুন। রবীন্দ্রসঙ্গীতের একজন ক্ষুদ্র গায়ক হিসেবে আমার এটি মনে হয় তাঁর সমস্ত সৃষ্টিকর্ম ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। আমি যখন তাঁর কোন একটি গান হারমোনিয়ামে তুলে গাওয়ার চেষ্টা করি, তখন মনে হয় এই গানটিই আমার প্রিয়, আবার কিছুদিন পর অন্য একটি গানের স্বরলিপি ব্যবহার করে হারমোনিয়ামে গাইলে তখন ঐ গানটি আমার প্রিয় বলে মনে হয়। অর্থাৎ শিল্পী  হিসেবে তাঁর সব গানই আমার গাছে প্রিয়। আবার একটি গান যত বেশী গাই তত ভাল লাগে। এ এক অপূর্ব অনুভূতি; তাই তাঁর গানকে উপলব্ধির মানসিকতা চাই।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯১৫টি গান রচনা করেছেন। ধ্র“পদী ভারতীয় সঙ্গীত, বাংলা লোকসঙ্গীত ও ইউরোপীয় সঙ্গীতের ধারা তিনটিকে আত্মস্থ করে তিনি একটি স্বকীয় সুরশৈলীর জন্ম দেন। রবীন্দ্রনাথ অনেক কবিতাকে গানে রূপান্তরিত করেছেন। রবীন্দ্র-বিশেষজ্ঞ সুকুমার সেন রবীন্দ্রসঙ্গীত রচনার ইতিহাসে চারটি পর্ব নির্দেশ করেন। প্রথম পর্বে তিনি জ্যোতিন্দ্রনাথ ঠাকুরের সৃষ্ট গীতের অনুসরণে গান রচনা শুরু করেন। দ্বিতীয় পর্যায়ে পল্লীগীতি ও কীর্তনের অনুসরণের রবীন্দ্রনাথ নিজস্ব সুরে গান রচনা শুরু করেন। ১৯০০ সালে শান্তি নিকেতনে বসবাস শুরু করার পর থেকে রবীন্দ্রসঙ্গীত রচনার তৃতীয় পর্বের সূচনা ঘটে। এই সময় রবীন্দ্রনাথ বাউল গানের সুর ও ভাব তাঁর নিজের গানে অঙ্গীভূত করেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর রবীন্দ্রনাথের গান রচনার চতুর্থ পর্বের সূচনা হয়। কবির এ সময়ের গানের বৈশিষ্ট্য ছিল নতুন নতুন ঠাটের প্রয়োগ এবং বিচিত্র ও দুরূহ সুরসৃষ্টি।

রবীন্দ্রনাথ রচিত সকল গান সংকলিত হয়েছে গীতবিতান গ্রন্থে। এ গ্রন্থের পূজা, প্রেম, প্রকৃতি, স্বদেশ, আনুষ্ঠানিক ও বিচিত্র পর্যায়ে মোট দেড়হাজার গান সংকলিত হয়েছে। পরবর্তীতে গীতিনাট্য, নৃত্যনাট্য, নাটক, কাব্যগ্রন্থ ও অন্যান্য সংকলন গ্রন্থ থেকে বহু কালজয়ী গান এই বইতে সংকলিত হয়। রবীন্দ্রনথের সময় বাংলার শিক্ষিত পরিবারে নৃত্যের চর্চা নিষিদ্ধ ছিল। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ বিশ্ব ভারতীয় পাঠ্যক্রমে সংগীত ও চিত্রকলার সাথে নৃত্যকে যুক্ত করেন। এককথায় সঙ্গীত ভুবনকে তিনি পরিপূর্ণ রূপ দান করেছেন। তাঁর বিশাল সঙ্গীত ভুবন থেকে আমি যৎসামান্য ধারণা দেয়ার চেষ্টা এখানে করেছি। তাঁর জীবন এবং দর্শন সর্ম্পকে  আলোচনা করা বেশ দূরূহ―কারণ তিনি সাহিত্য-সংস্কৃতির সকল শাখায় অসামান্য অবদানের পথিকৃৎ। রবীন্দ্রনাথের একটি উক্তি সবসময় মনে পড়ে : ‘হয়তো আমি একদিন থাকব না, কিন্তু আমার সঙ্গীত আমাকে অনন্তকাল বেঁচে রাখবে’। প্রতিটি বাঙালি তার সঙ্গীতচর্চা সুস্থভাবে বুকে ধারণ করুক এবং এর প্রসার ঘটানোর কাজে সহযোগিতা করুক- এই প্রত্যাশই করি। পরিশেষে রবীন্দ্রনাথের কালজয়ী একটি গানের দুটি লাইন দিয়ে শেষ করি― ‘যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে ... তখন কে বলে গো সেই প্রভাতে নেই আমি’।





তারেক রেজা
আমার রবীন্দ্রনাথ


রবীন্দ্রনাথ আমার--এই উচ্চারণের মধ্যে তীব্র অহংবোধের প্রকাশ স্পষ্ট। অন্য সবার থেকে বিচ্ছিন্ন করে আমরা কোন একজনকে কিংবা কোনকিছুকে একান্তভাবে আমার করে নিতে চাই। কাউকে নিজের করে নিতে হলে কখনো কখনো নিজের যোগ্যতারও পরীক্ষা দিতে হয়। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের ওপর আমার অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয় শর্তাবলি উপেক্ষিত হলেও ক্ষতি নেই। কারণ, এই নিবন্ধে রবীন্দ্রনাথের প্রতি কেবল আমার ভালোবাসারই প্রকাশ থাকবে। অর্থাৎ এই মুহূর্তে আমি শর্তহীন সমর্পণের প্রতিই পক্ষপাত দেখাব। ভালোবাসি--এই আনন্দে ভেসে ভেসে আমি রবীন্দ্রনাথের ঘাটে এসেই নোঙর করতে চাই। রবীন্দ্রনাথকে দেখার ছলে নিজেকে দেখারও এ-এক অপূর্ব কৌশল।

কবিতা কি তা বোঝার আগেই আমরা কবিতার প্রেমে পড়ি। একইভাবে না-বুঝে কবিতার ¯্রষ্টার প্রতিও আমাদের প্রেম জাগ্রত হতে পারে। ‘বিপুলা এ পৃথিবীর কতটুকু জানি’- রবীন্দ্রনাথের এই পঙ্ক্তির অনুকরণে নিশ্চয়ই বলা যাবে_ রবীন্দ্রনাথের বিপুল সৃষ্টিসম্ভারের সামান্য অংশেই আমার অধিকার জন্মেছে। এই অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রস্তুতিপর্ব অনুসন্ধানের চেষ্টায় নিজের শৈশবকেও এক ঝলক দেখে নেওয়া সম্ভব। আমার শৈশবে রবীন্দ্রনাথের এঁকে বেঁকে চলা নদীর তীর ঘেঁষে হেঁটে বেড়ানো কিংবা বৈশাখের সেই নদীতে হাঁটু ডুবিয়ে ছোট মাছ ধরার স্মৃতি আজও অম্লান। আর সেই যে তালগাছটি, যে সব গাছ ছাড়িয়ে আকাশে উঁকি দেয়, তার কথাই বা কি করে ভুলি? মাকে পাল্কিতে তুলে নিয়ে অনেক দূরে যাওয়ার গল্পটিও আমার মতো অনেকের শৈশবকেই রাঙিয়ে রেখেছে আজও। ‘সেই যে আমার নানা রঙের দিনগুলি’-তাকে আমি সোনার খাঁচায় বন্দি করে রাখতে চাই নি, কিন্তু রবীন্দ্রনাথকে হৃদয়ে স্থাপন করে আজও আমি মুক্তির আনন্দ খুঁজে বেড়াই। এই রচনায় আমি সেই আনন্দেরই দু’চারিটি অশ্রুজল ছড়িয়ে দিতে চাই। যদিও বলেছি ছড়িয়ে দেব, কিন্তু সে কেবল কথার কথা। আসলে রবীন্দ্রনাথকেই জড়িয়ে ধরতে চাই।

রবীন্দ্র-সঙ্গীতের শ্রোতা আমি। কিন্তু তাঁর গানকে পাঠ করার যে আনন্দ তার অনেক কিছুই তো সুরের সম্মোহনে হারিয়ে ফেলি। সুরে ভেসে যাওয়ার কাজটি অনায়াসে চলতে পারে, কিন্তু রূপসাগরে ডুব দিয়ে অরূপরতন অন্বেষণের ইচ্ছে যার আছে, তাকে ডুবতে হবে রবীন্দ্রনাথের গানের বাণীতে। গানের ভেতর দিয়ে ভুবন দেখেছেন কবি। এবং এই ভুবনই তাঁর কাছে সবচেয়ে সুখকর-সুন্দর-সুপরিচিত। তিনি বলেছেন, ‘আমি যখন গান বাঁধি তখনি সব চেয়ে আনন্দ পাই। মন বলে- প্রবন্ধ লিখি, বক্তৃতা দিই, কর্তব্য করি, এ-সবই এর কাছে তুচ্ছ।’ এই উপলব্ধিকে তিনি কবিতায় প্রকাশ করেছেন এইভাবে : ‘যবে কাজ করি,/প্রভু দেয় মোরে মান।/ যবে গান করি,/ ভালোবাসে ভগবান।’ কেবল ভগবানই নয়, ভগবানের প্রতিনিধি মানুষের ভালোবাসাও তিনি গানের ভেতর দিয়ে লাভ করেছেন। তিনি বলেছেন : ‘গানে যে আলো মনের মধ্যে বিছিয়ে যায় তার মধ্যে আছে এই দিব্যবোধ যে, যা পাবার নয় তাকেই পেলাম আপন ক’রে নতুন ক’রে। এই বোধ যে, জীবনের হাজারো অবান্তর সংঘর্ষ হানাহানি তর্কাতর্কি এ-সব এর তুলনায় বাহ্য--এই’ই হল সারব¯‘- কেননা, এ হল আনন্দলোকের বস্তু, যে লোক জৈবলীলার আদিম উৎস।’ এই আদিম উৎসের কাছে ফিরে যাওয়ার আনন্দ তিনি কেবল তাঁর গানের শ্রোতা কিংবা শিল্পীর জন্য বরাদ্দ করেছেন বলে মনে হয় না, তাঁর গানের পাঠককেও তিনি মুক্তপ্রাণে সেই আনন্দ দান করেন।

আমি আমার অভিজ্ঞতা ও অভিব্যক্তিকে ছন্দে বেঁধে রাখতে চেয়েছি, কবি হওয়ার স্বপ্ন দেখেছি। আমার সেই স্বপ্নও রবীন্দ্রনাথেরই দান। শৈশবেই ছন্দের প্রতি প্রবল আকর্ষণ বোধ করি। ভাবনাকে ছন্দে সাজানোর চেষ্টা করতাম। আর সেই সময় কবিতা বলতে আমি অন্ত্যমিলযুক্ত কবিতাই বুঝতাম। আমি অন্ত্যমিল ঠিক রেখে যা-তা লেখা শুরু করি। সেই খাতাগুলো দেখলে এখন আমার খুবই হাসি পায়। এই হাসির মধ্যে নিজের প্রতি ভালোবাসার প্রকাশটাও অস্পষ্ট থাকে না। আমি বুঝতে পারি, সেই ছন্দের খেলা থেকেই কবিতার প্রতি আমার প্রেম তীব্রতর হয়েছে। স্বীকার করি, কবি হওয়ার চেষ্টায় কিছুটা ভাটা পড়েছে, গদ্যের ঘাস কাটতে গিয়ে কবিতার বাগানের পরিচর্যা ব্যাহত হয়েছে। ফলে আগাছায় ছেয়ে গেছে আমার কবিতার ঘর-গেরস্থালি। তবুও কেউ যখন ঠাট্টা করে কিংবা ভালোবেসে কবি বলে সম্বোধন করেন, খুবই ভালো লাগে আমার। এই ভালো-লাগার বিচিত্র কারণের একটি এই যে, কবিতার কাছাকাছি থাকার যে আনন্দ রবীন্দ্রনাথ আমার মনে ছড়িয়ে দিয়েছেন, সেই আনন্দের সামান্য অংশ হলেও আমি অধিকার করতে পেরেছি।

রবীন্দ্রনাথের গানের কথা বলছিলাম। গীতবিতানের নিবিড় পাঠক আমি। তাঁর অনেক গানই আমার শোনা হয় নি, কিন্তু পাঠ করেছি এবং পাঠের ভেতর দিয়ে অনুভব করার চেষ্টা করেছি কীভাবে পৃথিবীর সঙ্গে নিজের সম্পর্ক নির্মাণের মাধ্যমে নিজেকেও নতুন করে সৃষ্টি করা যায়। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘আমরা যখন কবিতা পাঠ করি তখন তাহাতে অঙ্গহীনতা থাকিয়া যায়; সংগীত আর কিছু নয়-- সর্বোৎকৃষ্ট উপায়ে কবিতা পাঠ করা।’ কিন্তু তাঁর গীতবাণী পাঠে অঙ্গহানীর ব্যাপারটা মোটেই অনুভূত হয় না। হয়তো পাঠের সময় গানের সুরটাও মনের ভেতর ভেসে ওঠে। কিংবা নিজের সুরেই রবীন্দ্রনাথকে গেয়ে নেই মনে মনে।  রবীন্দ্র-সঙ্গীতের প্রতি যে-বয়সে আমার প্রেম জন্মেছে, সে-বয়সে তাঁকে বোঝার কথা নয়। তখন হয়তো সুরের সম্মোহনেই মুগ্ধ হতাম আমি। তখনো গীতবিতান আমার হস্তগত হয় নি, গান শুনে শুনে সেই গানের বাণী আমি খাতায় লিখে রাখতাম। সেই খাতাগুলো খুললেই বোঝা যায়, কত শব্দ আমার কলমের ডগায় এসে নতুন অবয়ব ও অর্থ লাভ করেছে। সেই বাণী মুখস্থ করে একা একা গুনগুন করতাম। কাছের বন্ধুদের শোনাতাম কখনো কখনো। ওরা মুগ্ধ হতো একথা নিশ্চয়ই বলা যাবে না, কিন্তু আমি ছিলাম ক্লান্তিহীন। জোর করে গান শোনাতাম বলে আমার কাছের বন্ধুদের অনেকেই আমাকে এড়িয়ে চলত। ঘনিষ্টজনকে ত্যাগ করেও আমি কখনো অস্বস্তি বোধ করিনি, কারণ আমার সঙ্গে ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। সেই রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে আমার সম্পর্কের কতটুকুই বা এই লেখায় উন্মোচিত হতে পারে!





মামুন মুস্তাফা
যেভাবে রবীন্দ্রনাথকে দেখি


বালকবয়সে স্কুলের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ‘প্রশ্ন’ কবিতা আবৃত্তির ভিতর দিয়ে রবীন্দ্রনাথের সাথে আমার প্রথম পরিচয়। এরপর আর থেমে থাকতে হয়নি। সোনার তরী, চিত্রা, মানসী, বলাকা কাব্যগ্রন্থের ভিতর দিয়ে রবীন্দ্রনাথ আমার হয়ে উঠেছেন। কিন্তু কি শুধুই কবিতা? আজ আমি ভাবি--রবীন্দ্রনাথ যদি শুধু কবিতাই লিখতেন কিংবা ছোটগল্প অথবা গান! রবীন্দ্রনাথের তাতে কিছু যায় আসতো না। বরং বাংলা সাহিত্য তাঁর অকৃপণ দানের অভাবে অপূর্ণ থেকে যেত। আমার বিশ্বাস রবীন্দ্রনাথ যে শাখাতেই কলম ধরতেন, সেখানেই তিনি বিশ্ব স¤্রাট হয়ে উঠতেন। নামমাত্র একটি উদাহরণ যদি টানি, তবে বলতে হয়--ভানুসিংহের পদাবলী ইতিহাস ও ঐতিহ্যের ধারায় বৈষ্ণব পদাবলীর যোগ্য উত্তরসূরি হয়ে উঠেছিল কেবল রবীন্দ্রনাথের অপার বিস্ময়াভিভূত দর্শন-চিন্তার কারণে। সুতরাং তিরিশের প্রণিধানযোগ্য কবি বিষ্ণু দে যথার্থই বলেছিলেন, ‘বাংলার ছোট ঐতিহ্যের ধারায় রবীন্দ্রনাথের বিরাট আবির্ভাব একটা প্রাকৃতিক ঘটনা।’

পৃথিবীর প্রায় সব প্রাচীন ও প্রধান ধর্মমতও মোটামুটি একইরকম। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের আধ্যাত্মলব্ধ দর্শন তাঁর ধর্মচিন্তাকে নতুন পথে হাঁটতে শেখায়। এমন কিছু বলে যা বহুশ্র“ত হয়েও নতুন এবং গভীরতর ব্যঞ্জনাময়। তাঁর সেই অন্তর্লোকে জীব-মানুষের চেতনা-বিশ্ব আলোকিত করে আছেন এক জ্যোতির্ময় সত্তা। ইনি এমন এক উপস্থিতি, যাঁর অভ্যন্তর থেকে নিরন্তর শুভবোধ, কল্যাণ এবং মুক্তির বিচ্ছুরণ ঘটছে। রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন রচনায় তাঁর এই ধর্ম-দর্শনের আবেগ ও উত্তপ ছড়িয়ে পড়েছে বলেই রবীন্দ্রনাথ আবালবৃদ্ধবনিতার সম্মুখ শিয়রে ঠাঁই করে নিয়েছেন। আমার রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং তাঁরই মতো সীমার বৃত্ত থেকে অসীমের মুক্তিতে আলোকবর্তিকা হয়ে আজও পথ দেখায়।

রবীন্দ্রনাথের কবিতা, গান কিংবা কথাসাহিত্য ব্যতিরেকেও বৈষ্ণব রসবোধে উদ্ভাসিত ভানুসিংহের পদাবলী, নাটক, প্রবন্ধ, নৃত্যনাট্য, চিত্রকলা সবখানেতেই তিনি তাঁর সমকালকে উত্তীর্ণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। যে কারণে বৃটিশশাসিত ভারতবর্ষের রাজনীতি, সমাজনীতি ও অর্থনীতির ক্ষেত্রে তাঁর চিন্তা ও প্রচেষ্টা যেমন সমাজে প্রতিষ্ঠিত করার উদ্যোগ পরিলক্ষিত হয় তেমনি সেই ভাবনাগুলো তাঁর সমগ্র সাহিত্যকর্মেও প্রতিফলিত হতে দেখি।

সুতরাং আধুনিকতার মানদ-ে রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য সাম্প্রতিক, সমকালীন ও সমসাময়িক হয়েও বৃহদার্থে শাশ্বত, ভাস্বর এবং চিরকালীন। আর তাই রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর সত্তর বছর পরেও বাংলা সাহিত্যের অনেক বিখ্যাত ও আলোচিত আধুনিক  সাহিত্যিকদের দেউটি নিভতে নিভতে আজ আর দুএকটি মাত্র অবশিষ্ট থাকলেও থাকতে পারে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ আজও সমান দেদীপ্যমান, চিরকালীন আধুনিক।     






অনুপম মুখোপাধ্যায়
আমার রবীন্দ্রনাথ


রবীন্দ্রনাথের পুজো করার বিষয়টা কখনো ফ্যাশনের বাইরে কি যাবে? সম্ভবত না। এটা বাঙালির রক্তের অন্তর্গত অভ্যাস, যে সে বিরাট এবং বিপুলকে নিজের মতো করে কেটেছেঁটে নিয়ে তাকে একটা দৈবী রূপ দেয়। এভবেই বৈদিক হিন্দুধর্ম বাংলাদেশে এসে লোকধর্মে পর্যবসিত হয়েছে। আরবের ইসলামও এখানে এসে কেমন যেন অন্যরকম রূপ নিয়েছে। এগুলো বলার এক্তিয়ার আমার না হয় নেই, কিন্তু এটা খুব মনে হয় যে আমরা আমাদের বিরাট মানুষদের ওইভাবেই লোকায়ত করে নিয়েছি, তাঁদের বিশ্বজনীনতা থেকে ‘মুক্ত’ করে ।

আমরা অনেকেই রবীন্দ্রনাথের যৌবনকে স্বীকার করতে চাই না। আমরা তাঁর চঞ্চলতাকেও ভুলে থাকতে চাই। আমরা চাই তিনি একটা আকারমাত্র হয়ে বেদীর উপর থাকুন বসে, আমরা ফুল ছুঁড়ে দিতে পারলেই হল। অথচ এই মানুষটির চোখের দিকে প্রতিবার তাকাই, আর আমার বয়স যায় কমে। এই যে একটা গদ্য লিখতে বসলাম, আমার বয়স আর ৩৪ থাকল না, ১৬ হয়ে গেল... পাঠক , এক কিশোরের লেখা পড়ুন। তার আদর আর নালিশগুলো বুঝুন। শীর্ষেন্দুর ঘুনপোকা উপন্যাসের সেই চরিত্রটার মতো অবস্থা আমার মাঝে মাঝে। সে লোকটা রবীন্দ্রনাথকে তার আস্তিকতার এক নাম করে তুলেছিল, আমি আমার সকল মুগ্ধতা তাঁকে দিয়ে প্রায় নিঃস্ব হয়ে বসে আছি। এ কি একরকম সর্বনাশ! হতে পারে। সেই ১৫-১৬ বছর বয়স থেকে লোকটাকে খুঁজে চলেছি, নিজের সঙ্গে মেলাতে চেয়েছি কতরকমভাবে ... কত যে লোভ হয়েছিল সেই শান্তিনিকেতনে গিয়ে ওঁর ওই বিরাট জুতোজোড়ায় একবার পা গলাতে, কাচের ঘেরাটোপে ঝুলে থাকা জোব্বাটা গায়ে দিতে, ওই চেয়ারগুলোয় বসে পড়তে একবার চুপিসারে... যদি পারতাম, কে জানে আর হয়ত কবিতা লিখতে পারতাম না, কিংবা ... লিখে ফেলতে পারতাম কবিতা ।

ব্যক্তি রবিবাবুকে জানার জন্য আমার আগ্রহের সীমা নেই। আমি তন্নতন্ন করে জানতে চেয়েছি ওঁকে। কিন্তু মানুষ হিসেবে লোকটিকে জানা হয়ত ছায়াপথের তারাগুলো গুনে ফেলার চেয়েও কঠিন কাজ। ওঁর কবিতায় আছে বিস্তর আড়াল। ওঁর কবিতা থেকে ওঁকে জানার চেষ্টা বৃথা বলেই মনে হয়। গল্প-উপন্যাস তো ছেড়ে দিন। নিজেকে কী করে সকলের সামনে রেখে আড়াল করতে হয়, কেউ ওনার কাছে শিখতে পারে। মেঘের আড়ালে এক স্কাইলার্ক উনি, জ্বলন্ত শিশিরের আড়ালে ঘাসের ডগাটি।
যে আগ্রহ নিয়ে একদা ছিন্নপত্রাবলী পড়েছি, মনে হয় না আর কোনো বই পড়েছি, বা পড়ব। ছাত্রজীবনে পরীক্ষার সকালে একদম না পড়া বইগুলোও ওভাবে পড়ি নি। যে কৌতূহলের সঙ্গে পড়েছি প্রশান্তকুমার পালের রবিজীবনী... শার্লক হোমসকেও পড়ি নি, আগাথা ক্রিস্টিকেও অতখানি রুদ্ধশ্বাসে ... না। মংপুতে রবীন্দ্রনাথ... বারবার মনে হয়েছে ওই মহিলা কত ভাগ্যবতী! পৃথিবীতে মৈত্রেয়ী দেবী যা পেয়েছেন, আর কেউ পেয়েছেন কি! কিংবা... ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো, রানু ... রবীন্দ্রনাথ চাইলে হয়ত আমি সমকামীও হয়ে যেতে পারতাম!! ‘তবু মনে রেখো...’ স্বকন্ঠে ওঁর ওই গান আমার মোবাইলের রিংটোন। কলার টিউনেও রবিবাবু। কেউ হয়ত স্টাইল স্টেটমেন্ট ভাববেন। সেটা নয়। তবে স্টেটমেন্ট তো অবশ্যই। ওঁর গান... একমাত্র ওঁর ছবির সঙ্গে ওঁর গান মেলে, আর কিছুর সঙ্গে নয় স্বয়ং জীবন ছাড়া ।

রবীন্দ্রনাথের অমৃত শুধু নয়, আমি নিজের গরলকেও মিলিয়ে নিতে চাই বারবার ওঁর বিষের সঙ্গে। ভানুদাদা আমার কালোর কৈফিয়ত। নিজের শয়তানের সাফাই। এটা অবশ্য আপনাদের সঙ্গে আলোচনা না করাই ভালো। যদি কখনো আত্মজীবনী লেখার কোনোরকম দুর্যোগ আসে, তখন আর এড়ানো যাবে না।
আর ... আমি রবীন্দ্রনাথের হয়ে লিখতে যাবো কেন? উনিই তো আমার হয়ে অনেক কিছু লিখে গেছেন! কত কবিতা লেখার পর ছিঁড়ে ফেলতে ইচ্ছে করে, যখন জানালা দিয়ে ভেসে আসে ওঁর গান। ওঁর গান শুনতে শুনতে কী অসহ্য ঈর্ষা যে হয় মাঝেমাঝে! খুনও কি করতে পারতাম ওঁকে, স্যালিয়েরি যেমন খুন করেছিলেন মোজার্টকে?

একটা কবিতা লিখেছিলাম ওনাকে নিয়ে। সেটা শুনবেন? সেটা দিয়ে শেষ করি?

হঠাৎ লোডশেডিং


একটা আলো নিয়ে দোতলায় আপনার ঘরে গিয়েছি
আস্তে করে টোকা দিয়েছি
আপনি দরজা একটু ফাঁক করেছেন
হাত বাড়িয়ে আলোটা নিয়ে বলেছেন
এবার যাও


এই কবিতায় কী বলতে পেরেছি জানি না, কিন্তু লিখে মনে হয়েছিল ওনাকে আমার অনেকটাই বলা হল। এর বেশি বলার ক্ষমতা আমার নেই। এর বেশি অভিযোগও নেই।





আব্দুল হালিম প্রামানিক
রবীন্দ্রনাথ এখনো অচলায়তনে


আমি রবীন্দ্রনাথ বিষয়ক পণ্ডিত নই। তবে গবেষকদের মতামত বুঝে বা শুনে যেটুকু ভাবতে শিখেছি তাতে তাঁকে নব-মূল্যায়নের প্রয়োজন আছে। এই নব-মূল্যায়নের খতিয়ান হয়তো অনেক হবে, হউক না। তাঁকে নিয়ে বাণিজ্য তো কম হচ্ছে না। বাণিজ্য হতে হতে রবীন্দ্রনাথ এখন দলীয় সম্পদ আর বিলাসিতায় পরিণত। আর কত দিন রবীন্দ্রনাথ মৃদু আলোয় স্পট-লাইটে একটুকরো চিত্র, ঘমপাড়ানি গান, পোশাকি কায়দায় বাঙালির বন্ধ বাক্সে আবদ্ধ থাকবে। রবীন্দ্রনাথ রাশিয়া ভ্রমণের আগে পাশ্চাত্যের অনেকগুলো দেশ ভ্রমণ করেছিলেন। কিন্তু রাশিয়া ভ্রমণের উদ্দেশ্যে ছিলো সেখানকার শিক্ষাব্যবস্থা পর্যবেক্ষণ করা। বলভেশিক আন্দোলনের পূর্বে রাশিয়ায় দরিদ্র জনগণের অবস্থা খুব শোচনীয় ছিলো। ১৯১৭ থেকে ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে রাশিয়ানরা অভূতপূর্ব পরিবর্তন সাধন করেছিলেন সাধারণ মানুষকে শিক্ষিত করে তোলবার মাধ্যমে। রাশিয়া ভ্রমণের তিনটি বিষয় (শিক্ষা, কৃষি, যন্ত্র) রবীন্দ্রনাথকে সমগ্র ভারতের কৃষি ও শিক্ষানীতি নিয়ে নতুন করে ভাববার প্রেরণা দিয়েছিলো। মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে রাশিয়ার উন্নয়ন রবীন্দ্রনাথের কাছে ছিলো অকল্পনীয়। সেখানকার শিক্ষাব্যবস্থার এই প্রসারের মূল কারণ ছিলো দেশের সমস্ত শ্রেণির মানুষকে সবদিক থেকে ‘মানুষ’ করে তুলবার শিক্ষানীতি প্রণয়ন। ঠিক যেন রবীন্দ্রনাথের চিন্তা-প্রসূত শান্তিনিকেতনের অনুরূপ, যে শিক্ষা ব্যবহারিক, শুধুমাত্র পুঁথিগত বিদ্যায় সীমাবদ্ধ নয়। রবীন্দ্রনাথ লক্ষ্য করেছিলেন- রাশিয়ানদের শিক্ষার ক্ষেত্রে একটা বিশেষ ব্যবহারিক দিক হলো- ওরা যা পড়তো তার সঙ্গে ছবিও আঁকতো। অর্থাৎ তাতে পড়ার বিষয়টা পড়ার সাথে সাথে সাবলীল চিন্তা এবং মনের ছবিতে পূর্ণাঙ্গ রূপ পায়। অন্তত মুখস্ত করতে হয় না। রবীন্দ্রনাথ বারবার শিক্ষার এই রূপকে জীবনযাত্রার সাথে মেলানোর কথা বলেছেন। অথচ রবীন্দ্রনাথের রাশিয়া ভ্রমণের শতবছর পরেও বাঙালিদের রাশিয়ার অনুকম্পা গ্রহণ করতে হচ্ছে। এতোদিন পর বাঙালিরা আধুনিকতার সর্বোচ্চ স্তরে এসে ভাবছে--বাঙালির উন্নতির মূলমন্ত্র কৃষির ব্যাপক ব্যবহারে আর সৃজনশীল শিক্ষায় অর্থাৎ মুক্তশিক্ষায়। অথচ রবীন্দ্রনাথ এই ভাবনা থেকে যখন আদর্শ শিক্ষানীতি ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মডেল স্বরূপ শান্তিনিকেতন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তখন আমরা তাঁর উদ্দেশ্য বুঝতে কতটুকু সক্ষম হয়েছি? এমনকি আজও তাঁর শিক্ষা মডেলের অনুরূপ কোনো মডেল গড়ে তুলে তাঁর শিক্ষাভাবনা প্রয়োগ করতে পারিনি। বরঞ্চ পেরেছি নাটক, কবিতা আর সুরের মুর্ছনায় বিলীন হতে। আমাদের দেশে আধুনিক শিক্ষানীতি হয়েছে, ব্যঙের ছাতার মতো গজিয়েছে স্কুল, জ্ঞানলাভের ভাগাভাগি নিয়ে চলছে লড়াই, কিন্তু মানুষকে মানুষ করে তুলবার প্রচেষ্টা কোথায়। সম্প্রতি রাজনৈতিক কায়দায় রবীন্দ্র-বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কাজ চলছে। সেখানেও পেশিশক্তির কম বাড়াবাড়ি হচ্ছে না। রবীন্দ্রনাথ বিশ্বকবি, তাহলে বিশ্ববিদ্যালয় কোথায় হবে তা নিয়ে আমাদের রাজনীতি কেন? কিন্তু কেউ কি একবারও ভাবেছেন--এই প্রতিষ্ঠানে রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাভাবনার প্রয়োগ হবে কিভাবে কিরূপে? এই প্রশ্নের উত্তরে ‘না’ বললেও ভুল হবার অবকাশ নেই। আমরা প্রায়শই একটা কথা বলে থাক-- ‘রাবিন্দ্রীক-চর্চা’। এর অর্থ একটু খেয়াল করলেই দেখা যায় তাঁর কবিতা, নাটক, গান বিষয়ক আলোচনার মধ্যেই সীমিত। কিন্তু ‘রাবিন্দ্রীক-চর্চা’ কথাটার সাধারণ অর্থ হলো তাঁর দর্শনকে লালন, পালন ও বিশ্বাস করা। অস্বীকার করার উপায় নেই, রবীন্দ্রনাথ তাঁর নিজ দর্শনেই কবিতা, নাটক, গান রচনা করেছেন। এগুলোর চর্চায় আমরা তাঁর দর্শনকেইবা কিভাবে কতটুকু লালন করছি? সাধারণ অর্থে তাঁর দর্শন; মানুষকে ‘মানুষ’ হিসেবে বিবেচনা করা, অসাম্প্রদায়িক চিন্তা, সৃজনশীল/মুক্ত/আনন্দদায়ক শিক্ষা, এবং পল্লী-সমাজের মূল্যায়ন। প্রবন্ধ, নাটক, কবিতা, গানে এগুলো কি তবে বলা হয়নি। রবীন্দ্র-চর্চা করতে হলে তাঁর দর্শন চর্চা প্রয়োজন না-কি শুধু সুর সাধনা প্রয়োজন এই প্রশ্নটি থেকেই যায়। আমরা মুখেই বলি রবীন্দ্রনাথ সবার জন্য, তবে বাস্তবে যেন শুধুই ‘রবীন্দ্র-ঘরনা’র সম্পদ। এ নিছকই তাঁকে লাল ফিতায় আটকে সিঁকায় তুলে রাখার মতো। আসলে রবীন্দ্র প্রেমীরা রবীন্দ্রনাথের দর্শন সর্বস্তরের মানুষের কাছে পৌঁছাতে ব্যর্থ হয়েছেন। আজ কবিকে নিয়ে ঋতু মিলিয়ে গানের রের্কড আর ট্যাক্সের টাকার অনুদানে নাটক মঞ্চায়ন হচ্ছে। উদ্দেশ্য, রবীন্দ্রনাথের বাণীর প্রসার। বাস্তবে, লুটেপুটে খাওয়া। অবশ্য স্ব স্ব ক্ষেত্রে অভিনেতারা হাততালি পাচ্ছেনা তা নয়। অন্তরালে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে বাজারজাতকরণে ব্যস্ত সবাই। আর এই চর্চাও মোড়কে বন্দি ‘রবীন্দ্রনাথ’ সমাজের গোটাকতক পোশাকিদের অধিকারে। প্রগতিশীলতার হাতলে লেপটে আছে রবীন্দ্রনাথ। সাধারণ মানুষ এসবের কাছে আসবে কি করে? চাল, ডাল, তেল, নুনের হিসাব করতে যাদের ঘাম ঝরে তাদের সুরের মূর্ছনায় ভাসবার ফুসরত কতটুকু? শর্তের সীমা ডিঙিয়ে রবীন্দ্রনাথের সংকলন বের হচ্ছে। এ বড় আনন্দের। এর উদ্দেশ্য রবীন্দ্রনাথের প্রসার নাকি বস্তাপচা প্রকাশকদের শুধুই বাণিজ্য। এখন রবীন্দ্রনাথ ‘ডিসকাউন্টে’ পাওয়া যায়, তাঁর ধ্যান-ধারণা না-- শুধু পুঁথিটাই। ব্যবসা হতে হতে কবে যে তাঁর ধ্যান-ধারণাও বাজারে উঠবে কে জানে। ক’জনইবা কেনেন ‘রবীন্দ্রনাথ’ রবীন্দ্রনাথকে বুঝবার জন্য। না-কি পারিবারিক আভিজাত্য প্রকাশ আর ড্রয়িং রুমের শো-পিছ হিসেবে, বাহারি আলমিরায় সাজানো সংকলনে বাড়ির কর্তার ভাবখানা এমন যেন তারা ‘রাবিন্দ্রীক পরিবার’। রবীন্দ্রনাথ ব্রিটিশ শাসনের একশ বছর পর বলেছিলেন--‘না পেলুম শিক্ষা, না পেলুম স্বাস্থ্য, না পেলম সম্পদ’। আর আমরা বাঙালিরা রবীন্দ্রনাথের নোবেল প্রাপ্তির একশ বছর পর কি বলব... ভেঙ্গে মোর ঘরের চাবি/ নিয়ে যাবি কে আমারে, না-কি অন্য কিছু। যে দেশে রবীন্দ্র দিবসে আজও রবীন্দ্রনাথকে উপস্থাপনের একমাত্র মাধ্যম সঙ্গীত আর নৃত্যনাট্যে সীমাবদ্ধ সে দেশের মানুষ নিজেদের প্রয়োজনে রবীন্দ্রনাথকে উপলব্ধি করবে কীভাবে। আসলে রবীন্দ্রনাথ এখন চর্চায় নেই, ব্যবসায়ে এসে দাঁড়িয়েছে। শুনেছি, এখন তথাকথিত অভিজাত শ্রেণি আভিজাত্য প্রকাশের জন্য শান্তিনিকেতনে প্লট কিনছেন। যদি এটা সত্যি হয় তবে বাঙালির রবীন্দ্রনাথ এখন অভিজাতদের আভিজাত্য প্রকাশের মাধ্যম হয়েছেন নিঃসন্দেহে। এ আমাদের লজ্জা নাকি গর্ব? রবীন্দ্রনাথ সমাজ, শিক্ষা, সংস্কারের যে অচলায়তন ভাঙতে চেয়েছেন শান্তিনিকেতনের সবুজ চত্ত্বরে সেই নিকেতনই অচলায়তন কী? না কি গোটা সমাজ, দেশ। তবুও প্রত্যাশা অচলায়তন একদিন সচলায়তন হবে।...ভাবনার শেষ কই...






সুপ্রিয়া রাণী দাস
অনন্য রবীন্দ্রনাথ : অনুভবে, অভিজ্ঞতায়

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, হয়তো বা কথা বলতে শেখার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর নামের সঙ্গে পরিচয়। অভিভাবকদের মুখে মুখে শুনে শেখা জীবনের প্রথম দিককার কবিতা ‘আমাদের ছোট নদী’। হয়তো বা শুধু আমি নয়, সবারই শিক্ষার সূচনা ঘটে এই কবিতা আবৃত্তির মধ্য দিয়ে। তারপর ক্রমশ বাড়তে থাকে তাঁর সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা! ‘আমাদের ছোট নদী’র পর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে আমার পরিচয় জাতীয় সঙ্গীতের সঙ্গে। অ্যাসেম্বলিতে দাঁড়িয়ে সবার সঙ্গে আমারও ঠোঁট মেলানো জাতীয় সঙ্গীতের চরণে। গুরুদেবকে প্রথম দেখেছি মামার বাড়িতে! মামার ঘরে রাখা ছবিতে আজানুলম্বিত আলখাল্লা গায়ে, দীর্ঘ শ্মশ্রুমণ্ডিত রবীন্দ্রনাথকে প্রথম দেখা । আমরা ছোট ছোট ভাইবোনরা আলোচনা করতাম উনি ভাত খান কী উপায়ে! স্কুলের প্রায় প্রতি শ্রেণিতেই পাঠ্য ছিল তাঁর কবিতা বা গল্প। এরই মধ্যে পরিচয় ঘটে গেছে তাঁর রচিত সঙ্গীতসম্ভারের সঙ্গেও। সত্যি বলতে সেই বালক বয়সে বুঝে উঠতে পারিনি বড়রা এই ধীর লয়ের গান শুনে কী সুখ পান! দশম শ্রেণিতে পড়াকালীন সময়ে আমার এক বান্ধবী জন্মদিনে উপহার দিয়েছিল ‘চোখের বালি’ বইটি। কয়েকদিনের মধ্যেই পড়ে শেষ করে ফেলেছি, তাৎপর্য বুঝিনি কিছুই। আমার ছোট মামা ছিলেন বাংলাসাহিত্যের ছাত্র। এস.এস.সি. পরীক্ষার ছুটিতে মামাবাড়ি গিয়ে পড়ে ফেলেছি ‘গল্পগুচ্ছ’। রবীন্দ্রসাহিত্যের প্রতি আমার ভালোবাসার শুরু সেখান থেকেই। তবে সবচেয়ে বেশি আলোড়িত করেছিল তাঁর ‘হৈমন্তী’ গল্পটি । কলেজ পর্যায়ে পাঠ্য এই গল্পটি শুধু আমি নয়, প্রতিটি সদ্য তরুণ মনকেই জোরে নাড়া দিয়ে যায়। আমারই বয়সী একটি মেয়ের যন্ত্রণায় আমিও পারিনা স্থির থাকতে। সাহিত্যের যে কোন শাখায় তাঁর সৃষ্টি একই সঙ্গে চমৎকৃত ও মোহিত করে দেয় ।

১৯০৫ খ্রিস্টাব্দের বঙ্গভঙ্গে ব্যথিত হয়েছেন, সমগ্র বাংলার প্রতি তাঁর ভালোবাসার নিদর্শন হিসেবে অমর হয়ে আছে তাঁর তখনকার রচিত ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’ গানটি। কবির আর্ত হৃদয়ের হাহাকার কি ধ্বনিত হয় না-‘মা তোর বদনখানি মলিন হলে আমি নয়ন জলে ভাসি’--চরণটিতে? আমার পঠন-পাঠনের ক্ষুদ্র অভিজ্ঞতায় সাহিত্যিক রবীন্দ্রনাথের পাশাপাশি ব্যক্তি রবীন্দ্রনাথ আলোড়িত করেছেন আমাকে। রবীন্দ্রনাথের উচ্চারণ : ‘সত্য যে কঠিন, কঠিনেরে ভালোবাসিলাম’, জীবনসংগ্রামে কি আমাদেরকে আশাবাদী করে তোলে না? স্কুল-কলেজে সারাংশের জন্য পড়েছি অনেক কবিতা। তাদের মধ্যে বহুল পরিচিত ও জনপ্রিয় কবিতাংশের মধ্যে ছিল-- ‘কেরোসিন শিখা বলে মাটির প্রদীপে...’, ‘শৈবাল দীঘিরে কহে উচ্চ করি শির...’, ‘একদা ছিলনা জুতা চরণ-যুগলে...’, ‘নদীর এপার কহে ছাড়িয়া নিঃশ্বাস...’, ‘কেন গো মা বসুমতী এতই কৃপণা...’ প্রভৃতি। সম্মান শ্রেণিতে পড়তে গিয়ে দেখেছি রবীন্দ্রনাথ ক্ষণিকা কাব্যে এমনি কত চরণ লিপিবদ্ধ করেছেন। চারপাশের জীবন বিষয়ে কতটা জ্ঞান থাকলে এমনতর সৃষ্টি সম্ভব! তাঁর জীবন নিয়ে সমালোচনামূলক গ্রন্থ নীরদ সি.চৌধুরীর ‘আত্মঘাতী রবীন্দ্রনাথ’ বা আব্দুস শাকুরের প্রবন্ধ ‘ব্রাত্য রবীন্দ্রনাথ’ পড়লে যতটা না বিরূপতা জাগে তার চেয়ে অনেক বেশি সমবেদনার অনুভূতি হয়। শুধুমাত্র সম্ভ্রান্ত, শিক্ষিত আর সমৃদ্ধিশালী পরিবারের সদস্য হওয়ায় কত কিছু নীরবে সহ্য করতে হয়েছে এই মানুষটিকে। অথচ বলতে গেলে প্রায় কারো কাছেই হৃদয়ের দ্বার উন্মোচন করতে পারেন নি তিনি। একাই সয়ে গেছেন সকল যন্ত্রণা। তবু থেমে যাননি। তাঁর প্রতিটি সৃষ্টিকর্মে গেয়েছেন জীবনের জয়গান, বলেছেন ইতিবাচকতার কথা। তাঁর অনেক লেখাই প্রচণ্ড উদ্দীপক হিসেবে কাজ করে, কাজে আত্মনিয়োগ করতে অনুপ্রাণিত করে।





স্মৃতি রুমানা
মেয়েটি ও রবীন্দ্রনাথ


নির্মেঘ আকাশ ঝলমল করছে রোদে। ঘরের মধ্যে লুটোচ্ছে বাতাস ও রোদ। বাবা অফিস যাচ্ছে। বাবা ফিরে আসছে অফিস থেকে। খেলনা আনছে, রঙিন বেলুন আনছে, ললিপপ আনছে, বাবা ফিরে আসছে আনন্দ নিয়ে। সাভারের তিনতলা বাসার সেই দ্বিতীয় তলায় বাবা-মার সাথে বেড়ে উঠছে মেয়েটি। মেয়েটি তখন চার। সকালে বাবা অফিস চলে যাচ্ছে, মা মেয়েটিকে নিয়ে খেলছে। খেলছে, রান্না করছে, গান শুনছে। গানের সুরে কণ্ঠ মিলিয়ে দিয়ে মা ছাদে যাচ্ছে কাপড় শুকোতে। মেয়েটি বড় হচ্ছে। খুব দ্রুতই বড় হচ্ছে। আর তখন রবীন্দ্রনাথ মার সুরের ভেতর দিয়ে জন্ম নিচ্ছেন মেয়েটির বুকের গভীরে। তখন ধীরে ধীরে মার বুকেও জন্ম নিচ্ছে গভীর ক্ষত। ধীরে ধীরে বাবা দূরে সরে যাচ্ছে। মার কাছে থেকে। মেয়ের কাছ থেকে। মেয়েটি বুঝতে শিখছে। আকাশে মেঘ জমছে। বাতাস দমকা হচ্ছে। দমকা বাতাস ঝড়ো হচ্ছে। মা আর মেয়েটি ছিটকে পড়ছে ইঞ্জিনিয়ার বাবার জীবন থেকে। তখন গ্রামে। নানাবাড়ীতে। সমবেদনা মুছ্ েগিয়ে ধীরে মার জীবনে যুক্ত হচ্ছে অবহেলা। মেয়েটির জীবনেও। সব বুঝতে শুরু করেছে মেয়েটি। বুঝতে শিখেছে তার বাবা নেই। তার বাবা অন্য হয়ে গেছে। তার বাবা হয়তো তখনও ফিরে আসছে অফিস থেকে। কিন্তু তার জন্য আনন্দ হয়ে বাবা আর ফিরে আসছে না। তখন মা হন্য হয়ে ফিরছে একটা চাকরির জন্য। সেই অস্থির অবহেলার জীবনে আবার রবীন্দ্রনাথ ফিরে আসছে মার কাছে। মেয়েটির কাছেও। রবীন্দ্রনাথ ফিরে আসছে বিপুল স্বস্তি হয়ে। ‘আমার নিশীথরাতের বাদলধারা,/ এসো হে গোপনে/ আমার স্বপনলোকের দিশাহারা।/ ওগো অন্ধকারের অন্তরধন, দাও ঢেকে মোর পরান মন.../ আমি চাই নে তপন, চাই নে তারা।/ যখন সবাই মগন ঘুমের ঘোরে, নিয়ো গো, নিয়ো গো,/ আমার ঘুম নিয়ো গো হরণ করে।/ একলা ঘরে চুপে চুপে এসো কেবল সুরে রূপে/ দিয়ো গো, দিয়ো গো,/ আমার চোখের জলের দিয়ো সাড়া।’-সারাদিনের ছুটোছুটি ফিরে মা রবীন্দ্রনাথের এই গানে প্রাণ পেতে দিয়ে মেয়েকে বুকে নিয়ে কাঁদছে। মার কান্নায় হুহু করে জল আসছে মেয়েটির চোখে। মেয়েটি কাঁদছে। কাঁদতে কাঁদতে মেয়েটিও গলা মিলিয়ে দিচ্ছে--একলা ঘরে চুপে চুপে এসো কেবল সুরে রূপে/ দিয়ো গো, দিয়ো গো,/ আমার চোখের জলের দিয়ো সাড়া’য়। পুরনো সেই রেকর্ড প্লেয়ারে কিশোর কুমারের ভরাট গলায় যখন  বেজে উঠছেÑযদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চলো রে’-তখন ভেঙে পড়া মাকে চনমনে লাগছে মেয়ের কাছে। মায়ের মুখের স্মিত হাসিটি মেয়েকে আশ্বস্ত করছে। তখন মেয়েটিকে আশ্বস্ত করছেন আসলে রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথ তাঁর সুরের ঐকতানে মেয়েটির প্রাণের ভেতর স্পর্শ করছেন গভীর মমতা হয়ে। গল্প শুনতে শুনতে মেয়েটি বড় হচ্ছে। অ-তে অজগর, অজগরটি আসছে তেড়ে/ আ-তে আম, আমটি আমি খাব পেড়ে আওড়াতে আওড়াতে মায়ের কাছে ‘কাবুলিওয়ালা’ পড়ছে। নিজেকে মিনি ভেবে মেয়েটি কতদিন কাবুলিওয়ালার অপেক্ষায় থেকেছে! কাবুলিওয়ালা কি তার বাবা! অথচ যখন কেউ জিজ্ঞেস করছে--‘বাবার কাছে যাবে?’--মেয়েটি যেন  মিনি হয়ে বলছে ‘হামি বাবাকে মারবে।’ তখন মা কি কষ্ট পেত মেয়ের কথা শুনে! তখন মা কি হারিয়ে যেত ফেলে আসা দিনগুলোতে! মা তখন গান শুনছে--‘যা হারিয়ে যায়, তা আগলে বসে রইব কত আর/ আর পারি নে রাত জাগতে হে নাথ, ভাবতে অনিবার।’ ওদিকে মেয়েটি তখন ডুব দিচ্ছে গল্পগুচ্ছ-এ। ‘দেনাপাওনা’র নিরূপমা তাকে কাঁদাচ্ছে, ‘পোস্টমাস্টার’র রতন তাকে কাঁদাচ্ছে, ‘ছুটি’র ফটিক তাকে কাঁদাচ্ছে; ‘অতিথি’র তারাপদ তাকে উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে এখান থেকে ওখানে, ‘সমাপ্তি’র মৃন্ময়ীর সঙ্গে সেও একটা দস্যি মেয়ে হয়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে, ‘ইচ্ছাপূরণ’র সুশীলচন্দ্রের বাবা সুবলচন্দ্রের শাসনের কথা জেনে তার মনে পড়ে যাচ্ছে বাবার কথা। কোথায় বাবা! কোথায় কে জানে!
এভাবে বাবাকে অন্যের বাবা হতে দিয়ে মেয়েটি বড় হচ্ছে। স্কুলে যাচ্ছে। ছুটির দিনে গান গাইছে। মার রেকর্ড প্লেয়ারে শোনা গান--‘মেঘের কোলে রোদ হেসেছে, বাদল গেছে টুটি/ আজ আমাদের ছুটি। / আহা, হাহা, হা। / আজ আমাদের ছুটি ও ভাই, আজ আমাদের ছুটি।/ আহা, হাহা, হা।/ কী করি আজ ভেবে না পাই, পথ হারিয়ে কোন্ বনে যাই, কোন্ মাঠে যে ছুটে বেড়াই সকল ছেলে জুটি। আহা, হাহা, হা।/কেয়া-পাতার নৌকো গড়ে সাজিয়ে দেব ফুলে-/ তালদিঘিতে ভাসিয়ে দেব, চলবে দুলে দুলে। রাখাল ছেলের সঙ্গে ধেনু চরাব আজ বাজিয়ে বেণু, মাখব গায়ে ফুলের রেণু চাঁপার বনে লুটি। আহা, হাহা, হা।’--কিন্তু মেয়েটি গায়ে ফুলের রেনু মাখতে পারছে না। একদিন মা বরং রঙিন শাড়ি পরে বসে যাচ্ছে বিয়ের পিঁড়িতে। বসে ঠিক যাচ্ছে না, বসতে বাধ্য হচ্ছে। একটা মেয়েকে নিয়ে একজন নারী গলগ্রহ হয়ে উঠেছে। নিজের পরিবার ও সমাজের কাছে গলগ্রহ হয়ে ওঠা সেই নারী, যে একদিন ‘তোমারেই করিয়াছি জীবনের ধ্র্রুবতারা’ বলতে যাকে বুঝেছে, তখনও তাকেই। অথচ তাকেই এমন এক সম্পর্কে জড়াতে হচ্ছে যা কোনদিন সে চায় নি। আর মেয়েটি ভেসে যাচ্ছে অন্তহীন জলে। নিঃসীম শূন্যতার মধ্যে হাহাকার করে বাজছে অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ। কী করবে মেয়েটি! যেদিক দুচোখ যায় চলে যাবে! গলায় দড়ি বেঁধে ঝুলে যাবে ফ্যানে! বেদনার ক্যাথারসিসে আটকে গেছে মেয়েটির জীবন। তখন সান্ত্বনা হয়ে তাকে আবারও কাছে ডাকছেন রবীন্দ্রনাথ--‘জীবন যখন শুকায়ে যায়, করুণাধারায় এসো/ সকল মাধুরূ লুকায়ে যায়, গীতসুধারসে এসো।/...বাসনা যখন বিপুল ধূলায় অন্ধ করিয়া অবোধে ভুলায়,/ ওহে পবিত্র, ওহে অনিদ্র, রুদ্র আলোকে এসো।’ মেয়েটি তাই ডুবতে ডুবতে ডোবে না। হাহাকারের মধ্যে ভেসে উঠে ছড়িয়ে পড়ছে আলোর মধ্যে। সাহিত্য পড়তে এসে আরও বেশি করে রবীন্দ্রনাথ পড়ছে। পরীক্ষার জন্য রবীন্দ্রনাথ পড়তে ভাল লাগে নি। আনন্দের জন্য রবীন্দ্রনাথ পড়ে মেয়েটি কাঁদছে। দিনে দিনে, অলস দুপুরে, মনখারাপ করা গোধূলীতে, সবুজ চায়ের কাপে, সকালের নাশতায় মেয়েটিকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রাখছেন রবীন্দ্রনাথ। বুকের মধ্যে শক্তি হয়ে মেয়েটির হয়ে রবীন্দ্রনাথ বলছেন--‘আমি মারের সাগর পাড়িদেব, বিষম ঝড়ের বায়ে/ আমার ভয়ভাঙা এই নায়ে।/ মাভৈঃ বাণীর ভরসা নিয়ে ছেঁড়া পালে বুক ফুলিয়ে/ তোমার ওই পারেতেই যাবে তরী ছায়াবটের ছায়ে।/ পথ আমারে সেই দেখাবে যে আমারে চায়-/ আমি অভয় মনে ছাড়ব তরী, এই শুধু মোর দায়।/ দিন ফুরালে, জানি জানি, পৌঁছে ঘাটে দেব আনি/ আমার দুঃখ দিনের রক্তকমল তোমার করুণ পায়ে।’

1 comment:

  1. এতক্ষণ পড়তে পড়তে কোথায় যেন মনটা হারিয়ে গিয়েছিলো। তা ব্যাক্ত করার উপযুক্ত শব্দ খুঁজে পাচ্ছি না।

    ReplyDelete